নতুন কোনো শহরে ঘুম থেকে জাগা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দের অনুভূতি আমার কাছে। কিন্তু রাতের ১২.৩০ এর ফ্লাইটের কথা শুনেই আমার ভ্রমণের আনন্দ উড়ে যায়। কারন আমি ঘুমকাতুরে। কিন্তু কি আর করা! সিঙ্গাপুর এয়ারওয়েজের ১২.৩০এর ফ্লাইটে আমরা যাত্রা শুরু করি। সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে ৪ ঘণ্টার যাত্রা বিরতি দিয়ে বেইজিং এর উদ্দেশ্যে রওনা হই বেশ উত্তেজনা নিয়ে। প্রায় ৫ ঘণ্টা চলার পর হঠাৎ বিমান ভয়ংকর ঝাঁকুনি দিতে, দিতে নীচের দিকে নামতে শুরু করলো। ভয়ে সব বাচ্চারা কান্না করছে,বড়রা কেউ কেউ হৈ চৈ করছে। হৈ চৈ বললাম কারণ পুরো ফ্লাইটে বাংলা ভাষী ৭/৮জন,তাই ওরা শ্রষ্ঠাকে ডাকছে, না অন্য কিছু বলছে, বুঝতে পারছিলাম না! আমার মোটামুটি ভালো বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকায় প্রথমে ভয়পাইনি। কিন্তু পরে যখন বিমানের এটেন্ডেন্টরা আসনের মাঝের চলাচলের জায়গায় শুয়ে পড়লো তখন ভয় ধরে গেল। এভাবে প্রায় ২০/২৫ মিনিট চললো। তারপর স্বাভাবিক হলো এবং সবাই স্বস্তি পেলো। মনে হলো এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।
বেইজিং এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাইরে এসে দেখি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করেছে আমাদের একজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি। এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে বের হয়ে মেট্রো রেলে আমরা বেইজিং হোটেলে পৌঁছে গেলাম। অবশ্য মেট্রো পরিবর্তন করতেহয়েছে। মজার বিষয় হলো আমাদের হোটেলের নামও 'বেইজিং হোটেল'।
হোটেলে ঢুকে ফ্রেস হয়ে খেতে বের হলাম। চীনা খাবার সম্পর্কে শুনে শুনে ঝুঁকি না নিয়ে KFC এর উপর ভরসা রাখলাম।পরে অবশ্য চাইনিজ ফুডে আমি বেশ উপভোগ করেছি। রেস্ট নিয়ে বিকেলে আশেপাশে ঘুরে প্রথম দিন কাটিয়ে দিলাম।
২য় দিনে গেলাম চীনের মহাপ্রাচীর দেখতে। প্রায় ২ ঘণ্টা লেগেছে শহর থেকে গ্রেটওয়াল যেতে।আমরা ক্যাবল কারের টিকেট কেটেহেঁটে ওঠার কষ্ট কিছুটা কমিয়ে নিলাম।একটা কথা বলে রাখা ভাল, টিকেট নিতে পাসপোর্ট লাগে বিদেশীদের।গাইডের ভাষ্য মতে ২ হাজার ৩০০ বছরের পুরোনো এই মহাপ্রাচীর প্রায় ২১ হাজার ১৯৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৫ থেকে ৮ মিটার উঁচু। মিং সাম্রাজ্যের সময় বিদেশী রাজাদের আক্রমন থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে এটি বানানো হয়। এই প্রাচীরকে পৃথিবীর দীর্ঘতম কবরস্থানও বলা হয়। কারণ এই মহাপ্রাচীর নির্মাণের সময় নাকি ১০ লাখেরও বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। হেঁটে আমরা বেশ দূরপর্যন্ত গেলাম। প্রাচীরের সিঁড়িগুলো অসম হওয়ায় উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্য বলে কথা!
হেভেন অফ টেম্পল'
পরদিন দেখতে গেলাম তিয়েনয়ানমেন স্কয়ার ও ফরবিডেন সিটি। তিয়েনয়ানমেন স্কয়ার বিশ্বের বৃহত্তম পাবলিক স্কয়ার। ১৯৮৯সালে এখানে গণতন্ত্রের আন্দোলনে এক হাজারেরও বেশি প্রতিবাদকারী নিহত হয়েছিলো। তিয়েনয়ানমেন স্কয়ারে গিয়ে সেইকথা ভেবে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
ফরবিডেন সিটি
তিয়েনয়ানমেন স্কয়ারের পেছনে অবস্থিত ১৪০০ শতাব্দীতে নির্মিত নিষিদ্ধ নগরী (ফরবিডেন সিটি)। মিং ও কুইং রাজবংশের ২৪জন সম্রাটের জন্যে রাজপ্রাসাদ ছিল এটি। সে সময়ে সম্রাটের বিশেষ অনুমতি ছাড়া সাধারণ জনগণের এই রাজপ্রাসাদে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো বলেই এর এ রকম নাম। এখন সেটা ইম্পেরিয়াল প্যালেস মিউজিয়াম নামে পরিচিত। এখানে চার হাজারেরওবেশি রুম রয়েছে। এসব রুমে লাল এবং হলুদ রংয়ের কারুকার্য করা। গাইডের ভাষ্যমতে এই প্রাসাদের ছাদ সোনা দিয়ে তৈরি, এবং ৯৮০টি ভবন ও ৯৯৯৯ টি রুম আছে! মিং এবং কিং সম্রাটদের থেকে শুরু করে ১৯১২ সালে চীনের শেষ সম্রাট পুই পর্যন্ত এই প্রাসাদই ছিল।এখানে রাজা রানী ছাড়া রাজার উপপত্নীরাও থাকতো! এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জটিল প্রাসাদ। এটি প্রাচীনঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান হিসেবে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত।
৪র্থ দিন গেলাম সামার প্যালেস। হোটেল থেকে ৩০ মিনিটের পথ। গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ কুনমিং লেকের সাথে ২৯০ একরজায়গা জুড়ে এর অবস্থান। পুরানো গ্রীষ্মকালীন স্থাপনাটির সুন্দর, সু্ন্দর ভবন, আঁকা হাঁটা পথ, সেতু, এবং দ্বীপপুঞ্জ সবই দেখার মতো।উদাহরণ হিসেবে বলছি, ওয়াক ওয়েতে সিমেন্টের ঢালাইয়ের উপর ততকালীন ইতিহাস চিত্রের মাধ্যমে বর্ণনা করেছে।ইতিহাসবিদের মতো আমাদের গাইড ভিক্টর বর্ণনা করলো ড্রাগন আর ফিনিক্স পাখীর ইতিহাস। ড্রাগন হলো রাজা আরফিনিক্স পাখী হলো রানীর প্রতীক। ফিনিক্স পাখীর হাত মাটিতে মানে রানীর হাতে পাওয়ার ছিল,আর ড্রাগনের হাত খালি মানে হলো তখন রাজার কোন পাওয়ার ছিলো না।এটি ১৯৯৮ সালে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।এখানে হ্রদের উপরের মার্বেল নৌকাটি আকর্ষণীয়।বিকেলে এলে কুনমিং লেকে ছোট ছোট নৌকায় ভ্রমণও বেশ আনন্দের হতো।কিন্তু আমরা এখানে এসেছি দুপুরবেলা। তাই এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলাম।
এরপর গেলাম অলিম্পিক ভিলেজ দেখতে। বেইজিং ২০০৪ সালের অলিম্পিকে হোস্ট ছিল। বিশাল অলিম্পিক পার্কের মাঠেরমধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অলিম্পিক কমপ্লেক্সের বিশেষত স্থাপত্যশৈলী আমরা হা- হয়ে দেখলাম। যেমন গ্রাম থেকে কেউ ঢাকায় আসলে হয়।আর কি! এটি 'বেইজিং ন্যাশনাল স্টেডিয়াম' বা 'বার্ডস নেস্ট' নামেও পরিচিত।অলিম্পিকের পর থেকে এটি অপেরা, পপ কনসার্ট এবং ফুটবল ম্যাচ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্যে ব্যবহার করা হয়।
বেইজিং এ আরো দেখার অনেক কিছু ছিল।যেমন, বেহাই পার্ক, জাতীয় জাদুঘর, আর্ট জোন, কনফুসিয়াস বেইজিং মন্দির,লামামন্দির,কোল হিল পার্ক,বেইজিং চিড়িয়াখানা। তবে এগুলোতে আমাদের যাওয়ার সময় হয়নি। চার রাত, পাঁচ দিনের বেইজিং সফরে এত বড় এবং ৩০০০ বছর বয়স্ক শহর দেখে শেষ করা যায় না।তার উপর যেখানে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের চমৎকার মিশ্রণ ঘটেছে।
পরদিন নানজিং এর উদ্দেশ্যে দ্রুতগতির ট্রেনে বসে বাহিরের দৃশ্য দেখতে দেখতে, বেইজিং শহরের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবছিলাম।এতে যতটা না ভাল লাগা ছিল, তারচেয়ে বেশী দুঃখ হয়েছে, আমাদের ঢাকা শহরের কথা ভেবে। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের শহর বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথমে থাকার কারণ আমাদের দারিদ্রতা নয়, আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার সাথে যারা জড়িত তাদের দুর্নীতি,অযোগ্যতা ও সদ্বিচ্ছার অভাব দায়ী বেশী।পুরো বেইজিং শহরটা মনে হলো গোছানো পার্ক।কোথাও গোলাপ ফুলের বাগান তো কোথাও পিটুনিয়ার ঢালা,কোথাও গাঁদা চাকা,কোথাও নাম না জানা বেগুনী ফুলের বল।আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখেছি বললে ভুল হবে,বলতে হবে হা হয়েছিলাম।যখন সিংঙ্গাপুর গিয়ে ওদের গোছানো শহর দেখেছি, তখন মনে মনে বলেছি, এত ছোট শহর বা দেশ তো পার্ক বানিয়ে রাখা সহজ। বড় দেশ সম্ভব নয়।কিন্তু চীন এত বড় দেশ আমার সেই ভুল ভেঙে দিয়েছে। বেইজিং থেকে নানজিং ট্রেনে যাওয়ার পথে খেয়াল করলাম রাজধানী থেকে প্রায় ৯৫০ কি মি দূরেও কর্তৃপক্ষের একইরকম যত্ন। কেউ কেউ বলবে তারা ধনী দেশ, তাদের বলবো ভুটানের কথা। ভুটান আমাদের থেকে অনেক গরীব, তবুও আমাদের থেকে পরিষ্কার এবং গোছানো শহর।।
6 মন্তব্যসমূহ
আপনার লেখাটা খুব ভাল লাগল। আমি 2012-2013 চিনে ছিলাম। ছবিগুলো দেখে মন ভাল হয়ে গেল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। চীন সম্পর্কে আপনার তো তাহলে অভিজ্ঞতা অনেক। আমি তো মাত্র 10/12 দিনের অতিথি।
মুছুনVery interesting, go ahead sister.
উত্তরমুছুনThanks a lot for your comments
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। অনেক সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশটা যে কবে সুন্দর হবে?
উত্তরমুছুনআপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।আমাদের দেশেরও আর্থিক উন্নতি হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশী। হয়নি মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি, তাই পরিবেশ ও সামাজিক সচেতনতার উন্নতি হয়নি। হয়তো বা এক সময় সব হবে,কিন্তু আমরা দেখে যেতে পারবো কি না, সেটাই কথা।
উত্তরমুছুন