মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'সমুদ্রের প্রতি রাবন” কবিতা পড়ে সেই যে কবে শ্রীলংকার প্রেমে পড়েছি, এখন আর তা মনে নেই। তাই তো কারো কারো কাছে রাবণের দেশ মনো হলেও,আমার কাছে শ্রীলংকা সৌন্দর্যের রাণী। অবশেষে সুযোগ হলো রাণী দর্শনে যাত্রা করার।
শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সে পা রাখার পর 'আই বো আন' বলে হাত জোড় করে অভ্যর্থনা জানানো বিমানবালাদের দেখেই আমার কিশোরী জীবনের লিজেন্ড শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার কথা মনে পড়ে গেল।তাঁর বিশেষ কায়দায় শাড়ী পরা(কেনডিয়ন), দৈহিক ও মানসিক শক্তি আমাকে বেশ আলোড়িত করতো।বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশনের দিকে যাওয়ার পথে মহামতি বুদ্ধের বিগ্রহ এমন ভাবে স্থাপিত যেন আমাদের আহবান জানাচ্ছে তাঁর শান্তির পথে।ইমিগ্রেশনে যাওয়ার আগে অনএরাইভেল ভিসার জন্য ২৫ডলার পেমেন্ট করে নিলাম।।ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কমন প্রশ্ন করলো, কয়দিন থাকবো, কেন,কোন হোটেল বলতে বলতে স্টিকার ভিসা দিয়ে দিলো।বাহিরে এসে দেখি আমাদের জন্য বুকিংডটকমের ড্রাইভার নেম প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কোন নতুন অচেনা দেশে গেলে আমার ভিতরে শিশুদের মতো সব কিছুতে বিস্মিত হওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি হয়।তাই চারিদিকে দেখছি।কলম্বো যেতে যেতে মনে হলো মার্কো পোলো,ঠিকই বলেছেন, শ্রীলংকা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুন্দর দ্বীপ এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর। মেরিনা বীচ হোটেল আমাদের গন্তব্য। সমুদ্রের পাশ দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটছে হু হু করে। পাশে নীল ভারত মহাসাগরের ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে তীরে। সড়কের পাশ দিয়েই ট্রেন লাইন।আমি পড়েছিলাম পৃথিবীর ১০ এডভেঞ্চারপূর্ণ ও বিপদজনক ট্রেন ভ্রমণে শ্রীলংকান ট্রেনলাইন আছে।আমার এই লাইন দেখে তাই মনে হলো।
হোটেলে ঢুকে ফ্রেস টুকটুক নিয়ে আশেপাশে দেখতে বের হলাম।রাতের বেলায় রাস্তায় মেয়েদের উপস্থিতি এবং পোশাক বলে দিচ্ছিল শহরটা নারীবান্ধব।যে কোন নতুন শহরে গেলে আমি বিষয়টা গুরুত্ব নিয়ে খেয়াল করি।এদেশের নারীদের জাতীয় পোশাক শাড়ী হলেও অভিজাত হোটেল, বয়স্ক কিছু নারী ছাড়া তেমন কাউকে শাড়ীতে দেখিনি।কলেজ ছাত্রীদের ইউনিফর্মও স্কার্ট। মনে হলো আজ থেকে ২০বছর পরে এদের জাতীয় পোশাক স্কার্ট হবে।কারন বেশীর নারী তাই পরে।শুধু পার্থক্য দৈর্ঘ্যের।ঈদের ছুটির কারনে সব কিছু বন্ধ থাকায় ফিরে এলাম হোটেলে।এসে পরের দিনের জন্য গাড়ী বুকিং দিতে এসে,হোটেলে বেশী পড়ে দেখে ক্যাঙ্গারু ক্যাব বুকিং দিলাম আমরা, এখানে উবার, পিক মি নামের অ্যাপসও চলে। তবে হোটেলের এক কর্মী বলল রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেনের টিকেট ট্রাই করতে,যদি পাওয়া যায়!তাহলে টাকাও বাঁচবে ভ্রমণও আনন্দদায়ক হবে।তার মতে শ্রীলংকায় ট্রেন জার্নি না করলে শ্রীলংকান সৌন্দর্য আধা দেখা হবে। এভাবে চান্স নিতে পারে, ব্যাক প্যাক ট্র্যাভেল যারা করে।কি আর করা!
সকালের জগিং আমার ভাললাগা বা নেশা।নতুন কোন দেশে বেড়াতে গেলেও আমি জগিং যাই। তবে তাতে দৌঁড়ানোর চেয়ে দেখার উদ্দেশ্য বেশী থাকে।কোন দেশের সহজ,শান্ত, স্নিগ্ধ রূপ দেখা যায় সকাল বেলায়।নাগরিক কোলাহল মুক্ত পরিবেশ আমাকে বেশী টানে। হোটেলের সামনে দাঁড়াতেই আমার মনে হলো এতো মাইকেল মধসূদন দত্তের 'কাঞ্চন সৌধ কিরিটিনীলংকা'।মুগ্ধ চোখে রেললাইনের পাথরের গায়ে এসে সাগরের ঢেউ ভাঙা পানির ছিটকে পড়ায় দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়ল ২০০৪ সুনামির সময় শ্রীলংকার ট্রেনের বগি ভেসে যাওয়ার নিউজটার কথা।তখন আমার অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল।কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। আমাকে দেখানোর জন্যই বোধ হয় একটি ট্রেন আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। এতে সমুদ্র আর ট্রেনের বাতাস মিলে আমাকে উড়িয়ে নেয়ার মতো অবস্থা হয়েছে!জীবনে প্রথমবার মোটা হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা ক্যাঙ্গারু ক্যাবে করে ক্যান্ডি হয়ে নুয়াহা এলিয়ার উদ্দেশ্য রওনা হলাম।দিনের আলোয় আমাদের স্বাক্ষাত হল কলম্বো সুন্দরীর সঙ্গে। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনন্য রূপ লাভ করেছে।সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সামান্য উচ্চতায় হওয়ায় ভারত মহাসাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ অবিরত তীরে এসে আঁছড়ে পড়ছে।
আমাদের দেশের মতোই শ্রীলংকা বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত। রাজধানী কলম্বো যে জেলায় তার নামটিও কলম্বো ডিস্ট্রিক। মেট্রোপলিটান এলাকা, শহরতলী সব নিয়েই কলম্বো। সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধ কোটি লোকের বসবাস। পর্যটকদের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল কলম্বো। পর্তুগীজ, ডাচ এবং বৃটিশরা শ্রীলংকায় ক্রমান্বয়ে রাজত্ব করেছে।ফোডগুলো সৌন্দর্য এখনো অমলিন ।এছাড়াও বিভিন্ন স্থাপনায়ও সেই সময়ের ছাপ রয়ে গেছে,বা যত্নের সাথে সংরক্ষন করা হয়েছে।বেশীর ভাল হোটেল বীচ সাইডে।বীচ সাইডেই রয়েছে ওদের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন সহ সব সরকারী প্রতিষ্ঠান। রাস্তা থেকে দেখা হিন্দু মন্দিরগুলো দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের মতো বাহিরের অবকাঠামোতে ছোট ছোট মুর্তি দিয়ে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়।যেতে যেতে আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড চন্দনা বলল কলম্বোর চমৎকার বিচ মাউন্ট লাভানিয়ার কথা। কলম্বো থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিচ এলাকায় আছে গভর্নর হাউজ। এছাড়াও সে চিড়িয়াখানা 'দেহিওয়ালা জু' এর কথা বলল। এই চিড়িয়াখানায় নাকি দুর্লভ প্রজাতির সব পশুপাখি আছে,তবে টুরিস্টদের মূল আকর্ষণ এলিফেন্ট শো। পথে যেতে আমরা বাহির থেকে বুদ্ধ মন্দির কেলানিয়া রাজা মহাবিহার, সিটি টাওয়ার, ওল্ড পার্লামেন্ট ও ভিক্টরিয়া পার্ক দেখলাম।
কলম্বো থেকে ক্যান্ডির রাস্তাটি বেশ ভালই লাগছিল আমাদের।এখানে শহরে গাড়ীর গতি ৪০ আর বাহিরে ১০০ এর বেশী তোলা নিষেধ।পাহাড়ি শহরে সবসময় ফুলের রং আর প্রজাতির বৈচিত্র্য নজর কাড়ে আমার। তবে এবার আশোক ফুলের আধিক্য এবং রং আমার নজর কেড়েছে। রাজা আশোকের দেশ বলে কথা।যিনি কলিঙ্গ যুদ্ধের হতাহতের সংখ্যা দেখে বিমর্ষ হয়ে বুদ্ধের শান্তি,অহিংস ও সর্বজীবে প্রেমের নীতি গ্রহণ করেন।প্রাচীন কাল থেকে আশোকফুলকে হয়তো বা তাই প্রেমের ফুল বলা হয়।পথে নারিকেলেরর বীথি দেখতে দেখতে আমার মনে হলো, এজন্যই এদেশের মেয়েদের মাথায় এত্ত চুল। বুঝলেন না,যার যেটা অভাব, তার নজর তো সেদিকে যাবেই।😂
এলিফ্যান্ট অরফানেজের আসতে প্রায় ৩ঘণ্টার বেশী সময় লেগেছে বৃষ্টি আর ট্রাফিক জ্যামের জন্য। এলিফ্যান্ট অরফানেজ এ ঢুকতে টিকেট কাটতে হয়। সার্ক ট্যুরিস্টদের জন্য ৮০০ রুপি।এই টিকেটে ছোট একটা হারবাল গার্ডেন ভিজিট করা যায়।পাশেই একটা চিড়িয়াখানা রয়েছে। চিড়িয়াখানা এবং অরফানেজ এক সাথে টিকেট নিলে ১০০০ রুপি। আমরা চিড়িয়াখানায় যাবো না।আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড চন্দনা বলল হাতীগুলো সব নদীতে শ্নান করতে গেছে আমরা তাই নদীর পাড়ে গেলাম।ওখানে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে তাদের খুঁনসুটি মানে বইয়ের ভাষায় যাকে জলকেলি বল আর কি! এরা নাকি দিনে দুইবার শ্নান করে।এখানে কয়েকটা অসুস্থ হাতিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে দেখাম। এলিফেন্ট অরফানেজ আসলে হলো শ্রীলংকা সরকারের একটি দাতব্য কার্যক্রম। হাতিকে শ্রীলংকায় পবিত্র মানা হয়,পরিবেশগত এবং মানব সৃষ্ট কারনে হাতির রক্ষনাবেক্ষন এখন জরুরী হয়ে গেছে।তাই অসুস্থ ও এতিম বাচ্চা হাতিদের জন্য এই অনাথ আশ্রমটি গড়ে তুলেছে সরকার । একশোর মতো হাতী রয়েছে। হাতিদের জন্য অনেক গুলো ঘর আছে। যে সব অসুস্থ হাতি সুস্থ যায় এবং এতিম বাচ্চা হাতিগুলো যখন একটু বড় হয়ে উঠে তখন তাদের আবার বনে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। আমি থাইল্যান্ডে এলিফেন্ট খামারে গিয়েছিলাম,এলিফেন্ট ট্যাকিং করেছি,বিভিন্ন সো দেখেছি। তবু এই অরফানেজে গেলাম, কারন হাতির জন্য এই ধরনের অরফানেজ পৃথিবী এই একটি। এত মুক্ত ভাবে একসাথে এত হাতীকে আমি আগে কখনো দেখিনি । ভালই লেগেছিল আমাদের, তবে বৃষ্টি পথ পিচ্ছিল করে আনন্দে বাগড়া দিয়েছিল।টাকা পে করে বেবি হাতীদের ফিডিং করানো যায়। কিন্তু আমাদের হাতে বেশি সময় ছিলনা বলে, করা হয়নি।
এরপর গেলাম হারবাল গার্ডেনে।শ্রীলংকার মতো আয়ুর্বেদীতে অভিজাত দেশের হারবাল গার্ডেন আমাদেরকে হতাশ করলো।এত্তছোট যে,শুরুতেই শেষ!তাই গাইড গাছের যত গুনাগুন বলছিল,আমাদের এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বের হয়ে গেল।আমার চোখ শুধু খুঁজছিল নতুন কোন সুন্দর গাছ। এখানে আয়ুর্বেদী ঔষধ বিক্রয়ের ছোট একটা ঘর ছিল।এরা বাগানে এনে আমাদের হারবাল টি খাওয়ালো।স্বাদ মন্দ ছিল না।এখানে রমনাপার্কের মতো ছোট ছোট কাঠবিড়াল দেখেছি।এরা এত দ্রুত দৌঁড়াদৌঁড়ি করে যে ঠিক মত ছবি তোলা যায় না।
বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা।এবারের লক্ষ্য পেরাডেনিয়া বোটানিক্যাল গার্ডেন। আমি পড়েছি, কয়েক শত বছরেরপ্রাচীন গাছ ও অসংখ্য প্রজাতীর গাছ দেখা যাবে। কিন্তু বৃষ্টির কারনে সব পণ্ড হলো। নামতেই পারলাম না।আমার মতো প্রকৃতি প্রেমী বিশেষ করে জন্য বৃক্ষ প্রেমীর জন্য অনেক কষ্টের ছিল বিষয়টা।রাস্তায় আসতে মোটা মোটা গাছ দেখে আগ্রহ আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারন বয়স্ক গাছ দেখা আমার কাছে খুব আনন্দের।
গাড়ি যত উপরে উঠছে সাথে সাথে রাস্তার চেহারাও বদলাতে লাগল দ্রুত । দূর আকাশের গায়ে যেন পাহাড়ের সারি হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর গাছের ফাঁক দিয়ে সুর্যের উঁকিঝুঁকি দেখতে দেখতে, ক্যান্ডির কাছাকাছি এসে আমরা ভিউ পয়েন্টে নামলাম। কিন্তু বৃষ্টির কারনে না দেখার না ছবি তোলার পরিবেশ, পরিস্থিতি রইলো। আমরা একটা রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেতে ঝাপসা চোখে পাহাড় আর গাছে ঘেরা ক্যান্ডি শহর দেখলাম।এই প্রথম বৃষ্টিকে আমার অসহ্য লাগছিল বিষন্ন মন নিয়ে চলে এলাম আমাদের হোটেলে।নেমেই চারিদিকে তাকিয়ে তো আমি 'থ'।ভিউ পয়েন্টের মতোই এখান থেকে ক্যান্ডি পুরো শহর দেখা যায়।ক্যান্ডি হলো শ্রীলংকার সাংস্কৃতিক রাজধানী ও অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। পাহাড় বেস্টিত, সমুদ্র সমতল থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত এই শহরটি বেশ পরিস্কার, ছিমছাম ও সুন্দর।ওলন্দাজ, ইংরেজ এবং পর্তুগীজ শাসনামলে এই শহরটি ছিল শেষ স্বাধীন দুর্গ সিংহলী রাজাদের। কলম্বো থেকে প্রায় ১২১ কিমি. দূরে অবস্থিত এই শহরটি পৃথিবীর সকল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র শহর। এখানে দেখার মত রয়েছে অনেক মন্দির আছে। আমাদের হোটেলের চত্বর থেকে Bahiravokanda Vihara Buddha Statue বা Big Buddha মন্দির সন্ধ্যার আলোতে এতটা মোহনীয় লাগেছিল সকালের অপেক্ষা না করে একটা টুকটুক নিয়ে রওনা দিয়েছি। আমাদের হো্টেল থেকে এই টেম্পল একদম কাছেই।তবে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠতে হয়।আমরা ২৫০রুপি দিয়ে টিকেট কেটে উপরে গেলাম। এই জায়গাটা ক্যান্ডির সবচেয়ে উঁচু জায়গা এবং মন্দিরটির উচ্চতা ৮৫৯ মিটার বিগ্রহের উচ্চতা ৮৮ মিটার বলল মন্দিরের এক সেবক। মন্দিরের এক জায়গায় লিখা ছিল 'বর্ষাকালে এখানে, শীত-গ্রীষ্মে ওখানে বাস করবো – মূর্খরা এভাবেই চিন্তা করে। শুধু জানে না জীবন কখন কোথায় শেষ হয়ে যাবে। ”-গৌতম বুদ্ধ (ইংরেজি বাক্যটাকে বাংলা করলে এমন কিছু দাঁড়ায়)কথাটা আমাকে কিছু সময় গম্ভীর করে দিল, এবং ভাবলাম জীবনের গাণিতিক হিসেব নিয়ে আমরা কতই না দৌঁড়ঝাপ করি।
সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেল বের হয়ে প্রথমেই আমরা গেলাম সেই বিখ্যাত টেম্পল” টেম্পল অফ টুথ রেলিক” এ।বুদ্ধিস্টদের অত্যন্ত পবিত্র একটি টেম্পল। গৌতম বুদ্ধের দাঁত এখানে রাখা আছে বলে এই মন্দিরটি তাদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র স্থান। প্রতি বছর জুলাই থেকে অগাস্টের মধ্যে কোন এক সময় পেরাহেরা নামক এক সপ্তাহ ধরে এখানে অনুষ্ঠান হয়। সৌভাগ্যজনক ভাবে আমরা যখন এখানে তখন এই অনুষ্ঠান চলছিল ।আগের রাতে আমার ড্রাইভার
মন্দিরে যেতে যেতে বলেছে। উৎসবের কেন্দ্রস্থল এই টেম্পলটিতে যেন সাজ সাজ রব চলছে। শত শত নর নারী সাদা কাপড় পরে হাতে লাল, নীল, পদ্ম নিয়ে, কেউ কেউ পদ্ম দিয়ে তৈরী ফুলে ডালা নিয়ে প্রবেশ করছে টেম্পলে।এখানে সাদা কাপড়কে পবিত্রতাও শুদ্ধতার প্রতীক মানা হয়। মন্দিরের সামনে একটা ফুলের দোকান দেখে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারিনি।কারন এত কালারের পদ্ম আমি আগে দেখিনি। আমরা ১০০০ রুপী দিয়ে টিকেট কেটে ভিতরে গেলাম। ভেতরে মৃদু ঘণ্টার আওয়াজ আর মন্ত্রের ধ্বনি মিলিয়ে অন্য রকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।ভেতরে স্বর্নের তৈরি গৌতম বুদ্ধের বিগ্রহ , তাঁর পবিত্র দন্ত এবং বুদ্ধের ধর্মীয় জিনিস আছে । সবাই লাইন করে ফুল দিচ্ছিল, তাই ফুল নিয়ে না আসায় আপসোস হলো। তবে ভীড়ে কারনে আমরা বেশিক্ষন থাকলাম না এবং ভাল ভাবে ছবি তোলাও গেলো না। এখানে নিয়ম হলো বৌদ্ধ মুর্তি বা টেম্পলকে পেছনে রেখে নিজে পোজ দিয়ে কোন ছবি তুলো যাবে না। এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনে যাওয়ার আগে বৌদ্ধ বিগ্রহের ওখানেও এই নির্দেশনা দেয়া ছিল।এটা দর্ন্ডনীয় অপরাধ। এই মন্দিরটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত।
রাজার বাড়িও এই মন্দির চত্বরের মধ্যে।মন্দির চত্বরে অনেক হাতি দেখলাম। শ্রীলংকায় হাতিকে পবিত্র মানা হয়।তাই বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে হাতির ব্যবহার হয়।আজ রাতেই এই উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠান। তখন হাতি গুলোকে রঙিন সাজে ও অলংকারে সাজানো হবে আর শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচবে।এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পুরো শহরে সাজ সাজ রব এবং এই অনুষ্ঠান দেখতে বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ট্যুরিস্টও এসেছে। তাই পুরো এলাকা জুড়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের তৎপরতা চোখে পরার মতো।
এই মন্দিরে নিরাপত্তা তল্লাশীর সময় স্কার্ট পরা মহিলা পুলিশদের আমার বেশ লেগেছিল।এতে শ্রীলংকার নারী পোষাকের উদারতাও প্রমাণ দেয়। মন্দিরের কাছেই পাত্তিরিপুয়া টাওয়ার।দেখতে দেখতে বেশ সময় পার হয়ে গেল।
এরপর আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। গাইড জেমস গ্যালারি যেতে বলেছিল কেনাকাটা করার জন্য।আমাদের আগ্রহ ও সময় না থাকায় হোটেলে ফিরে এলাম।নুয়ারা এলিয়া থেকে কলম্বো যাওয়ার রাস্তাটা সাময়িক নষ্ট থাকায় ক্যান্ডি থেকে আমরা কলোম্বোর পথে রওনা হই ভিন্ন পথে,উদ্দেশ্য একটা গীর্জা আর কেন্ডি ভাল করে দেখা।শ্রীলংকার পথে পথে টালির ছাদ দেয়া, গ্লাস লাগানো ছোট্ট ঘরের মতো মন্দির আর বুদ্ধ মুর্তি দেখে সহজেই বোঝা যায় এটি একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র। তবে গীর্জার উপস্থিতিও বেশ।যদিও জনসংখ্যায় খ্রিস্টানরা চতুর্থ। তবে আমার কাছে বুদ্ধু মুর্তি বা মাদার মেরীর মুর্তি বা গীর্জার উপস্থিতি ধর্মীয় কারনে নয় স্থাপনার সৌন্দর্য ও শিল্পের নান্দনিকতার কারনে চোখে ভাল লেগেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অভিনব কায়দায় মহিলাদের বাদাম বিক্রির করতে দেখলাম।পথে আমরা একটা ক্যাথলিক গীর্জা দেখতা গেলাম।ঘুরে দেখতে দিলো, কিন্তু ছবি তোলা নিষেধ। কারন হিসেবে বলল ট্যরোরিস্ট আক্রমণ। গীর্জার শান্ত, সৌম্য পরিবেশে আমরা মুগ্ধ হলাম।
গাড়ীতে আমাদের ড্রাইভার ওই আক্রমণ নিয়ে দুঃখ করলো।তার কাছে জানলাম এই দেশে ৫বার আজান দেয় রেডিও, টিভিতে।যা বিশ্বের আর কোন অমুসলিম দেশে নেই। দেশটিকে এককথায় বলা যায় শান্তির স্বর্গ।যেমন মনমুগ্ধকর পরিবেশ,তেমনি অসাম্প্রদায়িক ও বন্ধুপ্রতীম মানুষগুলো।
সময়ের অভাব আর বৃষ্টির কারনে পাহাড়ি সৌন্দর্য্যের লীলাভুমি শৈল শহর নুয়ারা এলিয়ায় আমাদের যওয়া হয়নি।নুয়ারা এলিয়াকে এ দেশের চা শিল্পের কেন্দ্র বিন্দু বলা হয়। আমাদের পরিকল্পনা ছিল ক্যান্ডি থেকে নুয়ারা এলুয়া যাওয়ার।
শ্রীলংকার আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল অনুরাধাপুর। প্রাচীনতম এই শহর। দেখা হলো না বিখ্যাত গুহা মন্দিরের শহর দাম্বুলা,এডামস পিক যেখানে হযরত আদম আঃ এর পায়ের চাপ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।যাওয়া হয়নি গল ফেস গ্রিন বিচ, রাবন রাজের টেম্পল, সিগিরিয়া, এন্ড অফ দ্যা আর্থ আরো কত কি! সবচেয়ে ব্যক্তিগত আপসোস হলো জাফনা না দেখার।
ক্যান্ডি থেকে বেশ লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমরা kurana katunayaka(বাংলায় লিখতে বানান ঠিক থাকবে না)পৌঁছলাম তখন বিকাল হয়ে গেছে।এটা বিমান বন্দরের কাছের একটা শহর। আমাদের গাড়িটি যখন শহরে প্রবেশ করছিল, তখন চারপাশের যতটুকু দেখলাম তাতে শহরটিকে আমার বেশ পরিচ্ছন্ন , ছিমছাম এবং সুন্দর বলেই মনে হল। আমাদের হোটেলটা সাগরের ধার ঘেঁষে। রাত পর্যন্ত সমুদ্রের লোনাজলের গন্ধ আর মন মাতাল করা বাতাসের সাথে মিতালী করেই কেটে গেল।রাতের ডিনার করলাম আমরা হেটেলের সাগরের উপর তৈরী করা সী ফড কর্ণারে মোহনীয় নীল আলোয়।যদিও আমি এসব খাই না তবুও পরিবেশের কারনে আসা।
আমার মনে হলো এত স্বল্প সময়ে জীব বৈচিত্র্যময় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি শ্রীলংকার কিছুই দেখা হয়নি। দেশটির সংস্পর্শে এসে, এর সৌম্য, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন রূপ দেখে এক অন্যরকম মায়া অনুভব করলাম বিদায়বেলায়।এত আন্তরিক এবং ভদ্র মানুষদের দেশকে ভাল না বেসে কি পারা যায়? স্বল্প খরচে, অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য শ্রীলংকা অদ্বিতীয়।আমার আনঅফিসিয়াল সেকেন্ড হোম বলে আমার ভালো লাগা একটু বেশীও হতে পারে।
(কেউ কিন্তু 'সেকেন্ড হোম' কেন সেই ব্যাখ্যা চাইবেন না😊)
2 মন্তব্যসমূহ
অনেক ধন্যবাদ।আমি আসলে চেষ্টা করছি নিজের ভ্রমণের গল্প গুলো লিখে রাখতে, যেন স্মৃতি গুলো হারিয়ে না যায়।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন