বিশ্বের প্রাচীন রাজধানীগুলির মধ্যে অন্যতম এবং বিশ্বের আসন্ন সুপার পাওয়ারের রাজধানী হলো বেইজিং।বেইজিং শহরেররয়েছে 3000 বছরের পুরানো দীর্ঘ ইতিহাস।800 বছর ধরে ছয়টি প্রাচীন রাজবংশের রাজধানী হিসাবে কাজ করেছে বেইজিং।আগামী বৈশ্বিক শক্তি, প্রাচীন সংস্কৃতি এবং আধুনিক শক্তির কেন্দ্র এই বেইজিং শহরে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের চমৎকার মেলবন্ধন নজরে পড়ে।এককথায় বলা যায় একটি মেগাসিটির সমস্ত সমসাময়িক বিলাসিতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা যেমনআছে,তেমনি আছে ঐতিহ্যবাহী অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা।এখানে সর্বত্র দুর্দান্ত অতীত এবং আধুনিক বর্তমানের সমন্বয়ের আভাস দেখা যায়।
গ্রেট ওয়াল
বেইজিং এর দর্শনীয় স্থান:
গ্রেট ওয়াল বা চীনের মহাপ্রাচীর,হেভেন অফ টেম্পল, তিয়েনয়ানমেন স্কয়ার, নিষিদ্ধ নগরী (ফরবিডেন সিটি)। সামার প্যালেস,অলিম্পিক ভিলেজ,বেহাই পার্ক, জাতীয় জাদুঘর, আর্টজোন, কনফুসিয়াস বেইজিং মন্দির, লামামন্দির,কোল হিল পার্ক,বেইজিং চিড়িয়াখানা ইত্যাদি।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়:
বেইজিং এর শীতও যেমন ঠাণ্ডা, তেমনি গ্রীষ্মও জ্বলন্ত।তবে বসন্ত এবং শরৎ বেশ আরামদায়ক এবং শুষ্ক। বিশেষ করে এপ্রিলথেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহগণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর ছুটি থাকে।তাই এই সময়ে, স্থানীয় অনেকেই তাদের নিজ শহরে বেড়াতে যায় দোকান এবংরেস্তোরাঁ বন্ধ রেখে, এবং চীনা অভ্যন্তরীণ পর্যটকরা রাজধানী দেখতে ভিড় জমায়, যার ফলে জনপ্রিয় টুরিস্ট জোনে ভীড় হয়।এইজন্য অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ এড়িয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।উৎসব:
চীনের রাজধানী হিসাবে, বেইজিং এ সারা বছর ধরে বিভিন্ন ধরণের উৎসব চলতে থাকে।জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে চীনা নববর্ষ এবং অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় দিবসের ছুটি হলো চীনের সবচেয়ে লম্বা ছুটি। বিশেষ করে চীনা নববর্ষে তোজমকালো উৎসব হয়।বিভিন্ন দেশের টুরিস্টদের কাছে এই বর্ণীল অনুষ্ঠান অসম্ভব আকর্ষণীয়।তারা নববর্ষের থিম নির্ভরচাইনিজ ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা উপভোগ করতে এবং চায়নার সংস্কৃতি,ইতিহাস,ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে এই সময়কে বেছেনেয়।এমন আশ্চর্যজনক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা নিতে কে না চায়।তবে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই ব্যস্ত সময় অনেকাংশে অস্বস্তিকর।এছাড়া গ্রেট ওয়াল ম্যারাথন বা বেইজিংয়ের বার্ষিক 798 আর্ট ফেস্টিভ্যাল হয় সেপ্টেম্বরের।পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মানুষের পছন্দের কুজিন চাইনিজ ফুড।এই খাবারের সুনাম দুনিয়াজোড়া।তবে চাইনিজ ফুডে ঘ্রাণ অনেকসময় বাঙালীদের নাক বিদ্রোহ করে।অবশ্য আমি বাংলাদেশী চাইনিজ ফুডের কথা বলছি না।চায়নিজ খাবারে মূলত পাঁচধরনের গন্ধ থাকে। ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধের সঙ্গে তাল রেখে এসব গন্ধের হেরফের হয়। মিষ্টি, টক, নোনা, তেতো আর ঝাল—এপাঁচ ধরনের গন্ধ থাকে।চীনের অঞ্চলভেদে ঘ্রাণ আর স্বাদের পার্থক্য হয়। যেমন সিচুয়ানের খাবারে ঝাল বেশী,উত্তরাঞ্চলে নোনাআর দক্ষিণাঞ্চলের খাবারে টকের প্রাধান্য বেশি।চাইনিজরা খাবারের সৌন্দর্যে বিশ্বাসী, তাই তারা সাধারণ এবং সাশ্রয়ী মূল্যেরবাড়িতে রান্না করা খাবার থেকে শুরু করে বিশ্ব-বিখ্যাত ডাইনিং এর খাবারের শৈলী ও পরিবেশনের নান্দনিকতা দৃষ্টিনন্দন।
কেনাকাটা:
অনেক টুরিস্টের বেইজিং ভ্রমণের একটি পছন্দ বিষয় হলো কেনাকাটা। বিশ্ব বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলি থেকে মানসম্পন্ন পণ্যের সন্ধানে আগ্রহী ক্রেতার জন্য শহরটি সত্যিই শপিং স্বর্গ।এখানে সাধারণ এবং সাশ্রয়ী মূল্যে জামাকাপড়,মুক্তা এবং চশমা থেকে শুরুকরে লাগেজ এবং চামড়ার পণ্য সবই পাওয়া যায়।তবে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় কেনাকাটার গন্তব্য হল ইয়ানশা এবংগুওমাও শপিং মল, জিদান স্ট্রিট এবং তিয়ানানমেন স্কোয়ারের কাছাকাছি রাস্তা যেমন ওয়াংফুজিং এবং কিয়ানমেন রাস্তা।আরভিন্ন কিছুর জন্য পাঞ্জিয়ায়ুয়ান অ্যান্টিক মার্কেটে উত্তম জায়গা (পাঞ্জিয়ায়ুয়ান ফ্লি মার্কেট নামেও পরিচিত)।যেখানে বিশেষপেইন্টিং, মূর্তি, সিরামিক, গয়না পাওয়া যায়।এই মার্কেটে প্রচণ্ড দর কষাকষি করতে হয়।এখানে বিক্রেতা তাদের পণ্যকে এন্টিকবা প্রাচীন জিনিস বলে দাবি করেন।যা বেশীর ভাগই মিথ্যে।সামার প্যালেস
নাইট লাইফ:
থাইল্যান্ড, বাহরাইন বা ইন্দোনেশিয়ার মতো টুরিস্ট বান্ধব নাইট লাইফ বেইজিং এ নেই।চীনের সামাজিক ব্যবস্থা অনেকাংশেরক্ষণশীল।তবে ঐতিহ্যবাহী অপেরা, অ্যাক্রোব্যাটিক্স এবং মার্শাল আর্টগুলির মতো ঐতিহ্যবাহী পারফরম্যান্স থেকে আধুনিককনসার্ট, পাব এবং ক্লাবে বিনোদনের ব্যবস্থা আছে।এছাড়া টিয়ানকিয়াও এলাকা এবং লাওশে টিহাউস টুরিস্টদের জন্য চীনালোকসংস্কৃতি উপভোগ করার জন্য ভালো স্থান।পার্টি-প্রেমী বা রাতের পেঁচা টুরিস্টদের সানলিতুন বার স্ট্রিট এবং কাছাকাছি দূতাবাস এলাকায় থাকা উচিৎ।টেম্পল অব হেভেন
ভ্রমণ টিপ:
বেইজিংয়ের কুখ্যাত ট্র্যাফিক জ্যাম থেকে বাঁচতে হলে পাতাল রেল ব্যবহার করা উচিৎ।এতে মূল্যবান সময়ের কয়েক ঘন্টা বেঁচেযাবে।বেইজিং মেট্রো সস্তা, সুবিধাজনক এবং বিদেশীদের জন্য ব্যবহার করা সহজও।যদিও পিক ওয়ারে অত্যন্ত ভিড় হতে পারে। শেয়ারিং বাইক ব্যবহার বেইজিং এ বেশ জনপ্রিয়।এছাড়া বেশিরভাগ হোটেল তাদের অতিথিদের বাইক ভাড়ায় দিয়ে থাকে।ফটোগ্রাফি টিপস:
বেইজিংয়ের সবচেয়ে আইকনিক ল্যান্ড মার্কগুলি হলো গ্রেট ওয়াল, নিষিদ্ধ শহর, প্যালেস মিউজিয়ামের উত্তর প্রবেশদ্বার থেকেরাস্তার ওপারে জিংশান পার্ক।বেইজিং হোটেল
বেইজিং থেকে স্পীড ট্রেনে নানজিং যাওয়ার পথে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আমাদের ঢাকা শহর আর বেইজিং এর তুলনাকরছিলাম মনে মনে।এ কয়েক দিনে বেইজিং শহরের সৌন্দর্য দেখে যতটা না ভাল লাগা ছিল, তার চেয়ে বেশী দুঃখ হয়েছে, আমাদের ঢাকা শহরের কথা ভেবে। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের শহর বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথমে থাকার কারণ আমাদের দারিদ্রতা নয়, আমাদের নগরব্যবস্থাপনার সাথে যারা জড়িত তাদের দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও সদ্বিচ্ছার অভাব দায়ী বেশী।পুরো বেইজিং শহরটা মনে হলো গোছানো পার্ক।কোথাও গোলাপ ফুলের বাগান তো কোথাও পিটুনিয়ার ঢালা,কোথাও গাঁদা চাকা,কোথাও নাম না জানা বেগুনীফুলের বল। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখেছি বললে ভুল হবে,বলতে হবে হা হয়েছিলাম।যখন সিংঙ্গাপুর গিয়ে ওদের গোছানো শহর দেখেছি,তখন মনে মনে বলেছি, এত ছোট শহর বা দেশ তো পার্ক বানিয়ে রাখা সহজ। বড় দেশ সম্ভব নয়।কিন্তু চীন এত বড় দেশ আমার সেই ভুল ভেঙে দিয়েছে। বেইজিং থেকে নানজিং ট্রেনে যাওয়ার পথে খেয়াল করলাম রাজধানী থেকে প্রায় ৯৫০ কি মিদূরেও কর্তৃপক্ষের একই রকম যত্ন। কেউ কেউ বলবে তারা ধনী দেশ, তাদের বলবো ভুটানের কথা। ভুটান আমাদের থেকে অনেক গরীব, তবুও আমাদের থেকে পরিষ্কার এবং গোছানো শহর।।
0 মন্তব্যসমূহ