প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার মালদ্বীপ হল ভারত মহাসাগরের মাঝে দ্বীপরাষ্ট্র।শ্রীলঙ্কার ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৪০০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে ১১৯২টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপের প্রায় ২০০টিতে মানুষের পদচারণা আছে।বাকী দ্বীপগুলো ভবিষ্যতের মাছ ধরা এবং পর্যটনের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।সরল, শান্ত ও মনোরম পরিবেশ,আদিম সমুদ্র সৈকত মালদ্বীপের প্রধান আকর্ষণ। যেখানে পানির রং কোথাও নীল, কোথাও ফিরোজা, কোথাও সবুজাভ। বিশুদ্ধ সাদা বালুকাময় সৈকতের সৌন্দর্য তো অপ্রতিদ্বন্দ্বী।বিশেষজ্ঞদের মতে মালদ্বীপের সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যবর্ধনের সবচেয়ে বড় অবদান রাখে প্যারোট ফিস। এসব মাছ প্রবাল প্রাচীর আহার করে এবং তাদের বৃষ্ঠা হলো মালদ্বীপের সাদা বালি।
মালদ্বীপ এমন একটি দেশ যার আয়তনের 99% সমুদ্র।তাই টুরিস্টরা মূলত মালদ্বীপে আসে ওয়াটার এক্টিভিটির আনন্দ উপভোগ করতে।কালারফুল মাছ আর প্রবালের সাথে সমুদ্র স্নান করতে কার না পছন্দ?এখানে পাঁচ হাজারেরও বেশি প্রবাল প্রাচীর এবং প্রচুর রিফ মাছ, প্রবাল এবং অন্যান্য অনেক সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্য রয়েছে, তাই সমুদ্রবিলাসীদের কাছে মায়াময় দ্বীপ এই মালদ্বীপ।যেখানে টুরিস্টদেরকে সাগরের স্বচ্ছ পানিই যেন সমুদ্রের নীচের একটি সম্পূর্ণ অন্য পৃথিবী অন্বেষণ করতে আমন্ত্রণ জানায়।
আমিও মালদ্বীপে গিয়েছিলাম প্যারাডাইস আইল্যান্ডে তেমনি স্বপ্নময় অবকাশ যাপনের জন্য।প্যারাডাইস আইল্যান্ডের সাথে বোনাস হিসেবে হুলমালে দ্বীপ আর মালে সিটি ভিজিট করেছিলাম।হুলমালে দ্বীপে অভ্যাসবশত সকালে হাঁটতে বেরিয়ে নজরে পড়ল ছোট্ট ঘরের মতো একটি 'বুক ভ্যান'। মস্কোর প্রতিটি স্ট্রীটে লাইব্রেরীর থাকার কথা পড়েছি, দেখার সুযোগ হয়নি।কিন্তু মালদ্বীপের একটি ছোট দ্বীপ হুলেমালের রাস্তায় ছোট্ট ঘরের মতো 'বুক ভ্যানটি' আমাকে চরম বিস্মৃত করেছে, কারন এখানে ভ্রাম্যমাণ মানুষ বা ট্যুরিষ্টই বেশী,স্থানীয়দের তুলনায়। এদের জন্য বই রাস্তায় খোলা ভ্যানে রাখা বা ফেরত নেয়ার মতো জটিল কাজ তারা কিভাবে করছে,এই ভেবে।পরে আমাদের হোটেল কর্মীর কাছে জানলাম বুক ভ্যানটির বেশীর ভাগ বই দান করা।খুবই ছোট সংগ্রহ কিন্তু উদ্যোগটাই আমাকে অবাক করেছে।সব বই গুলোই ইংরেজি আর পাঠক হলো মূলত টুরিস্টরা।তাদের কথা মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে সেলফ গুলো।যেমন-অভিধান,ম্যাপ, টুরিজম সংক্রান্ত বই রাখা আছে। এখান থেকে বই নিয়ে তারা বীচের বালিতে শুয়ে, বসে বই পড়ে এবং যাওয়ার পথে ফেরত দিয়ে যায় নিজ দায়িত্বে। আমার মনে হলো, আমরা টুরিজম ম্যানেজমেন্টে অনেকটা পিছিয়ে। শুধু হোটেলের অবকাঠামো বানালেই যে টুরিস্ট আসবে, এমন ভাবনার যুগ বহু পেছন রয়ে গেছে।এই বোধদয়ও হয়নি, আমাদের কর্তা ব্যক্তিদের।
মালদ্বীপের মানুষের শিক্ষার উন্নত হারের কারনে এখানে বই প্রতি ভালবাসা নিদর্শন মিলে 1945 সালে প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরী 'মজিদি গ্রন্থাগার'( Majeedi Library)তে গেলে।মালে সিটিতে বেড়াতে গিয়ে আমি দেখলাম গ্রন্থাগারটিতে আরবি, উর্দু, ধিবেহি ও ইংরেজি ভাষার বই রয়েছে।শুধু ইংরেজি ভাষার ৩৭,৯৭০ এরও অধিক সংখ্যক বই রয়েছে।এছাড়াও গ্রন্থাগারে আমেরিকান কর্নার, জাতিসংঘ সংগ্রহ, নারী ও লিঙ্গ বিষয়ক বিশেষ সংগ্রহ রয়েছে।সাময়িকী, প্রতিবেদন, পাণ্ডুলিপি, জার্নাল, সংবাদপত্র ও পুস্তিকা এসব তো আছেই।
মালদ্বীপের জাতীয় গ্রন্থাগার 'কনফারেন্স অফ ডাইরেক্টরস্ অফ ন্যাশনাল লাইব্রেরিস অফ এশিয়া অ্যান্ড ওশেনিয়া'(সিডিএনএলএও) এর সদস্য।এছাড়া গ্রন্থাগারের কিছু কর্মকর্তা "শ্রীলংকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন" এর সদস্য।
মালদ্বীপের সংস্কৃতি বিভিন্ন উৎস থেকে গৃহীত। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতি।নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় মালদ্বীপের জনগণ প্রধানত ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।তাই এখানকার মানুষের চেহারা, পোশাক, খাবার,জীবনাচরণ সব কিছুতেই শ্রীলঙ্কা ও ভারতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।আমি কোন ইতিহাসবিদ বা সমাজ বিশেষজ্ঞ নই।শুধু একজন সাধারণ ট্র্যাভেলার হিসেবে এইটুকু উপলব্ধি করেছি।আসলে আমি একজন 'বুক লাভার' বলেই হয়তো বইয়ের এই ছোট্ট আয়োজনও চোখে পড়েছে।
ভারত মহাসাগরের মাঝখানে, পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, এই সমুদ্র কন্যা আবেদনই আলাদা। সমুদ্রের অসীমতা এবং মায়াবী নীল জলের বিভিন্ন শেডের অতুলনীয় রূপ যা অন্য কোথাও দেখা যায় কি না, জানা নেই।এই দ্বীপপুঞ্জকে বর্ণনা করার মতো বিশেষণ আমার অভিধানে নেই।তবে ভাবতে কষ্ট হয়,পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে এই দেশটা সাগরগর্ভে হারায়ে যেতে পারে।কারন মালদ্বীপ বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর গড় উচ্চতা মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার।
0 মন্তব্যসমূহ