up

# শান্তির অন্বেষণে সুখী মানুষের দেশে(ভুটান)

 


ভুটান যাওয়ার পরিকল্পনা করি হঠাৎ।মাত্র ৪ দিন আগে।এতদিন পরিবারের অন্য সদস্যদের কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল।এবার ঈদের ছুটিতে ভিসা জটিলতার কারনে ভুটানে যাওয়ার মত দেয়।কারন ভুটানে পোর্ট এন্টি ভিসা।ভুটানে যাওয়ার পরিকল্পনার পর থেকে এক পরিচিত জন থেকে নেয়া ফোনে যোগেশ নামের এক ড্রাইভারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি অনলাইনে যাতে সময় বাঁচে ও ঝামেলা মুক্ত হয় ভ্রমণ। কিন্তু কোন ভাবেই পারলাম না।অবশেষে আমরা ১৮ আগষ্ট ড্রুক এয়ারে ঢাকা ছাড়লাম।এখানে বলে রাখা ভাল ড্রুক এয়ার ছাড়া ভুটানের পারো বিমানবন্দরে আর কোন এয়ারওয়েজের বিমান অবতরণ করতে পারে না, বিশেষ প্রশিক্ষণ নেয়া ২৫জন বৈমানিকই কেবল এই বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করতে পারে।বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ন বিমান বন্দর গুলোর মধ্যে পারো বিমানবন্দর প্রথম দিকে।তবে এটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি আছি নতুন দেশ দেখার আনন্দে বিভোর।বিমান আকাশে উড়ার প্রায় ৪৫/৪০মিনিট পরই আমার চোখ ছানাবড়া।জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখি সাদা মেঘের ঝোপ পাহাড়ের গায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।আর পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে পাইন গাছেরা যেন,আমায় হাতছানি দিচ্ছে। কোন দেশ বিমান থেকে এত সুন্দর লাগতে পারে আমার জানা ছিল না।দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যখন বিমান উড়ছিল আমার মনে হয়েছিল আমি বিমানে নয় হেলিক্যাপটারে আছি।অবশেষে পাহাড়কে ডানা দিয়ে প্রায় স্পর্শ করে বিমান থামল।



পারো বিমানবন্দরে। বিমানবন্দরে নেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। তবে সুশৃঙ্খল এবং পরিপাটী। যাত্রীর তুলনায় কাউন্টার বেশী হওয়ায় আমরা খুব তাড়াতাড়ি ইমিগ্রেশনশেষ করে ট্রাভেলার সিম নিলাম ৭দিনের প্যাকেজে।দাও নিল ২৯৯ রুপি।এখানে এসে যে কারো কাছে খটকা লাগবে এটা ভারতের প্রদেশ নাকি!আমি অবাক বিমানবন্দরের ভিতরে ভাঙাতে গেলে আমাকে ভারতীয় রুপি দিলো।যদিও ভুটানের নিজস্ব মুদ্রার নাম গুলট্রাম।তারপর বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিলাম দরদাম করে।পারো থেকে থিম্পুর ভাড়া নিবে ১২০০/১৫০০ রুপি।গাড়ীতে উঠার পর থেকে পারো চু নদী আমাদের সাথে চলেছে সাপের মত এঁকেবেঁকে,কখনো ডানে কখনো বায়ে।



 
 পারো চু নদী



থিম্পু যাওয়ার পথে আমাকে আরেকটা বিষয় অবাক করেছে তা হলো হলুদ রংয়ের সিমেন্টের ছোট ছোট বোর্ডের লিখা,যেমন-Be happy, Be positive ইত্যাদি।





পরিষ্কার পরিছন্ন রাস্তা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম আমাদের আগের থেকে বুকিং করা হোটেল 'সিটি হোটেলে'। হোটের ওয়েলকাম টি শেষ হওয়ার আগেই চেক ইন ফর্মালিটি শেষ।ফ্রেস হয়েই বের হলাম কালকের জন্য ট্যাক্সি ঠিক করতে।গেলাম এক ট্যাভেল এজেন্সিতে।তার কথা ভাল লাগলেও দাম বেশী মনে হওয়ায় চুক্তি না করেই ফিরে এলাম।এসেই আবার যোগেশকে ট্রাই করতেই পেয়ে গেলাম।সে পরদিনের সিটি টুরের জন্য আমাকে ট্যাক্সি দিল।এখানে সিটি টুর ট্যাক্সিনিতে হয় সময় ধরে, না হয় কতটা স্থান দেখাবে তার উপর দাম নির্ভর করে।সারাদিনের জন্য ট্যাক্সি ভাড়া হলো ২৫০০/৩০০০হাজার।

পরদিন যথা সময়ে হাজির আমাদের ড্রাইভার। এরা সময়ের ব্যাপারে খুব দায়িত্ববান। আমরা প্রথমে গেলাম কিংস মেমোরিয়াল, তারপর চাঙ্গাংখা লাখাং,রয়েল টেক্সটাইল একাডেমী, তাশিচো জং,পার্লামেন্ট, মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, সিমতোখাজং।সবশেষে গেলাম বুদ্ধু পয়েন্ট।

 
 বুদ্ধু পয়েন্ট



আর হোটেলে ফেরার পথে ক্লক টাওয়ার। ড্রাইভার ষ্টেডিয়াম দেখানোর কথা বললে আমরা নামিনি।কারন এটা আমাদের হোটেল থেকে হাঁটা দুরত্বে ছিল।যা আমি আগের দিন বিকালেই জগিং এ বের হয়ে ঘুরে এসেছি। আমার স্বভাব হলো কোথাও বেড়াতে গেলে সুযোগ পেলেই হাঁটাহাটি করা।মানে হলো আশপাশ দেখা, স্থানীয়দের জীবন যাপন বুঝার চেষ্টা করা।সম্ভব হলে কারো সাথে গল্প করা।ভুটানে এসেও তাই করেছি। সবচেয়ে মজার তথ্য পেয়েছি সকালে এক মন্দিরে একজনের সাথে তাদের দেশের বিয়ের আইন নিয়ে কথা বলে।সে সব অন্য কথা।





বিকালে হোটেলে ফিরে আবার আগামীকালের ভ্রমণ পরিকল্পনা শুরু করলাম।আমরা আগে থেকে ভেবেছিলাম থিম্পুতে তিন রাত থাকবো, কিন্তু আজকের ঘুরার পর মন পরিবর্তন করলাম। কালই পুনাখায় চলে যাবো।তাই ট্যাক্সি নিলাম এবার পুরো ভ্রমণ পর্যন্ত এতে কিছুটা সাশ্রয়ী হয়।কারন পুনাখা শুধু যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি নিলেও যাওয়া আসার ভাড়া দিতে হয়।আর সাথে রেখে দিলেও তাই। এর জন্য আমি ট্যাক্সি নিলাম ২৫০০ রুপি যাওয়া,পরদিন পুনাখার আশেপাশে দেখা ১৫০০রুপি পুনাখা থেকে পারো ৩৫০০ রুপি।কথা হলো যাওয়ার সময় দো চুলা পাস, বোটানিক্যাল গার্ডেন হয়ে পুনাখা যাবো।দো চুলা পাস এসে আমরা হিমালয়া রেন্জ পুরোটা এক সাথে দেখলাম, যা এক কথায় অসাধারণ।এছাড়াও এখানে আছে ১৬টি গুহা।যেখানে বসে একসময় সন্ন্যাসীরা ধ্যান করতেন।





তারপর গেলাম বোটানিক্যাল গার্ডেন। তবে এতে শীতে নানান ফুল থাকলেও এখন বিচিত্র প্রজাতির গাছ ছাড়া ফুলের দেখা পেলাম না।ভিতরে একটা লেক আছে যাতে বসার জন্য কাঠ দিয়ে সিঁড়ি করা আছে।লেকে পা ভিজিয়ে বসে ঝিঁঝিঁ পোকার গান শুনলাম কিছুক্ষণ। তারপর আবার পুনাখার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।থিম্পু থেকে পুনাখা যেতে সময় লাগে ২.৩০ মিনিটের মত।তবে আমরা বারবার রাস্তায় থেমেছি বলে আমাদের সময় লেগেছে অনেক বেশী। পথে দুটো ঝরনায়ও আমরা ছবি তোলার জন্য থেমেছি এবং দুপুরের খারার খেয়েছি Hotel lobesa তে । চমৎকার লোকেশন, পরিছন্ন পরিবেশ। দামও মোটামুটি সহনশীল। জনপ্রতি ৩৫০ রুপি।



পুনাখার ট্রাগন নেস্ট হোটেল ছিল অবাক করার মতো। পাহাড়ের গায়ে হোটেলের নাম না দেখলে বুঝতামই না এখানে কিছু আছে।কারন রাস্তা থেকে প্রায় তিন তলার মতো নীচে নামতে হয় সিঁড়ি দিয়ে।মোট ১৬টা রুম আছে আটটা কটেজে।পাশে দিয়ে বয়ে গেছে নদী, নদীর ওপাড়ে একটু ধান ক্ষেত তারপর আবার পাহাড়। অসম্ভব সুন্দর পরিবেশ।





পুনাখাতে এসে বিকালেই গেলাম ফ্যাটেলিটি টেম্পল। যা স্থানীয়দের কাছে পবিত্র। নিঃসন্তান দম্পতিরা এখানে পূজা দিতে আসে।মন্দির ছোট হেঁটে উপরে উঠতে হয় বেশ খানিকটা পথ।তবে পরিবেশ সুন্দর।

ফ্যাটেলিটি টেম্পল।

পরদিন ব্রেকফাস্ট করেই আমরা বের হলাম পুনাখা জং দেখতে।যার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।এখানে ঐতিহ্য, ইতিহাস, সৌন্দর্য সব কিছুর অপূর্ব সমাবেশ হয়েছে।বেশ সময় কাটিয়ে আমরা মেডিকেল ইনস্টিটিউ দেখে গেলাম suspension bridge ।গাড়ী থেকে নেমে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতে হয়।তবে ব্রীজে উঠলে মনে ভরে যায় নদীর চলার শব্দ, বাতাস আর পাহাড়ের হাতছানিতে।ব্রীজটা হাঁটতে গেলে নড়ে তাই ব্যালেন্স করে হাঁটতে হয়।আমার কাছে মজা লেগেছে, মনে হলো হাঁটায় ছন্দ তুলে।এই ব্রীজের অপর প্রান্তে আছে রাফটিং ষ্টেশন।তবে আপাতত বন্ধ।তাই আমার রাফটিং এর এডভেঞ্চার নেয়া হলো না।একটা ছোট দোকানের বাহিরে দাঁড়ায়ে আইসক্রিম খেতে খেতে বাতাসের গান শুনলাম কিছুক্ষণ।অবাক বিষয় হলো শহর থেকে এত দুরে এমন পাহাড়ি দোকানেও গায়ের দামে পন্য বিক্রি হচ্ছে।যা আমাদের দেশে ভাবা যায় না।



তারপর গেলাম Khamsum yulley namgyal chorten। এখানে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়।এরপর sangchhen dorhi lhuendrup nunnery গেলাম। বেশ সুন্দর টেম্পল। এখানে এতিম বাচ্চাদের থাকা, খাওয়া, পড়ার ব্যবস্থা আছে।সবশেষে গেলাম ন্যাশনাল লাইব্রেরী। বিকালেই আমরা হোটেলে ফিরলাম। রাতে স্থানীয় খাবার এমা দাতসি, কেওয়া দাতসি, জাশামারো স্বাদ নিলাম।এগুলো চিকেন, সবজি,চাল দিয়েই রান্না।শুধু রান্নার স্টাইল আলাদা।তবে এখানে মম খুব মজার।আমি বেশ কয়েক জায়গায় রাস্তার পাশের দোকানে মম খেয়েছি।ভেজিটেরিয়ান মম পাওয়া যায়।বেশীর ভাগ জায়গায় চিকেন মম ভাল হয়।তবে এখানে সবজির মমও চমৎকার।স্বাদ না নিলে খুব ভুল হবে।

দুই রাত তিন দিন পর আমরা রওনা হলাম পারোর উদ্দেশ্যে। মধ্য দুপুরেও আমাদের গাড়ি হেডলাইট অন করে গাড়ি চালাতে হচ্ছে।গাড়ির গতিও ২০/৩০ এর উপর উঠছে না। কারন মেঘ একটু পর পর পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে।সেই এক অন্য রকম অনুভূতি।







পারো আসতে দুপুর গড়িয়ে গেল।বিকাল বেলা আমরা আশেপাশে ঘুরলাম, কেনাকাটা করলাম টুকটাক। তবে সব কিছুর দাও অনেক বেশী মনে হলো আমার কাছে।এখানের বাজার ঘুরে মনে হলো বেশী জিনিষ ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশেরও আছে।তাই শপিং জমেনি।আমার আবার স্থানীয় প্রডাক্ট না হলে কিনতে ইচ্ছে করে না।কারন শুধু বিদেশি কিনতে চাইলে তো বাংলাদেশেই কেনা যায়।

পর দিন খুব সকালে টাইগার্স নেস্ট ট্রেকিং এর জন্য বের হলাম।দলের বাকী সদস্য পার্কিং লট থেকে একটু এগিয়েই রাস্তা দেখেরণে ভঙ্গ দিল।কিন্তু আমি এত সহজে হারার পাত্র নই।তাই একাই রওনা দিলাম। সবাই দেখলাম লাঠি নিল।আমি তা ছাড়াই রওনা দিলাম। কারন আমি রোজ ৪ কি.মি দৌড়াই।তাই আত্মবিশ্বাস ছিল।তবে শেষ পর্যন্ত ক্যাফেটেরিয়াই গিয়েই ফিরতে হলো।এখানে আসতে আমার ১ঘ.১০মি লেগেছে। আমি একটু পরে রওনা দেয়ায় এর উপরে যাওয়ার সঙ্গী পাই নি।তখন সবাই ওখান থেকে নামছে তাই অন্যরা পরামর্শ দিল একা না যাওয়ার।৩০/৪০মি.পর নামতে শুরু করলাম।নামার সময় কষ্ট হয় না তবে সতর্ক থাকতে হয়।নেমে এসে কিছু কেনাকাটা করলাম ছোট ছোট জিনিষ। ভুটান আমার কাছে শপিং এর জন্য বেটার মনে হয়নি।কারন এদের বাজারে নিজেদের প্রোডাক্ট নেই বললেই চলে।চীন,ভারতের জিনিষ বেশী। তাই দাম আমার কাছে বেশী মনে হলো।তবু টাইগার্স টেম্পলের এখানে কিছুটা কম মনে হলো।








বিকালটা কেটে গেলো পারোর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পারে চু নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে বসে থেকে আর হেঁটে।তারপর গেলাম ভুটানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ফানি ফটো সেশন করতে।এটা আমি খুব উপভোগ করি।তাই যখন এ ধরনের সুযোগ পাই তখনই পরি।








সকালে বিমানবন্দর এলাম।এখানে নিরাপত্তা তলাশির নামে কোন বাড়াবাড়ি নেই। যাত্রী কম কাউন্টারর বেশী হওয়ায় ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিক দ্রুত শেষ হলো।ল্যান্ডিং এর মত এডভেঞ্চার উপভোগের আশায় জানালার পাশের সিটে বসলাম। কিন্তু আমার আশা গুড়েবালি করে কয়েক মিনিটের মধ্যে বিমান টেকঅফ করল।আমি সুখানুভূতিতে চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভুটানকে গুডবাই বললাম।।

পুনাখা জং

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post