up

# ফয়েজ লেক রিসোর্ট


মহাকালের আবর্তে বিলীন হয়ে যাবে আরো একটি বছর।আমার জীবন থেকেও হারিয়ে যাবে একটা বছর।তাই নববর্ষ আর জন্মদিন উদযাপন করতে প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা বেরিয়েছি।তবে সাধারণত দেশের বাহিরে চলে যাই এই বিশেষ দিনকে উদযাপন করতে। কিন্তু এবার করোনার জন্য বিদেশ যেতে না পারায় দেশের ভিতর কোলাহলমুক্ত, নির্জন, নিরিবিলি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে নববর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।দেশের ভালো রিসোর্ট গুলোর প্রায় সব কয়টিতে আগেই যাওয়ায়এবার নতুন কোন রিসোর্টে যেতে চাইছিলাম।তখন পরিবেশ এবং লোকেশন মিলিয়ে ফয়েজ লেক রিসোর্টকে গন্তব্য স্হির করেছিলাম।



সকালবেলা ঢাকা থেকে নিজেদের গাড়িতে বের হয়ে রাস্তায় দুইবার বিরতি দিয়ে আয়েশি ভঙ্গীতে আমরা দুপুরে ফয়েজ লেক পৌঁচ্ছালাম। আমাদের রাস্তা চিনতে কোন সমস্যা হয়নি, কারন শহরের মাঝেই, পাহাড়তলীর খুলশী এলাকায়।রাস্তার পাশেই ফয়েজ লেকের নান্দনিক গেট।যা সহজেই নজর কাড়ে।থিম পার্কে প্রবেশ পথ আর রিসোর্টৈ প্রবেশ পথ আলাদা।রিসোর্টর ভিতরে গাড়ি প্রবেশের আগে ছোট- খাটো আনুষঙ্গিকতা আছে।গেট অফিসে বুকিং সংক্রান্ত তথ্য নিশ্চিত করতে হয়। তারপর ওরা প্রতিজনকে একটা কাগজের ব্রান্ড পরিয়ে দেয়।







গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে নৌকার জন্য খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হল।নৌকায় উঠার পর চারিদিকের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মুহূর্তেই পথ শেষ হয়ে গেল মনে হল।যদিও ইন্জিন চালিত নৌকায় 12/15 সময় লেগেছিল।







ফয়েজ লেক রিসোর্টে প্রথম বার এলেও এই লেকের ইতিহাস আমি আগেই পড়েছি।প্রাকৃতিক অনন্য সৌন্দর্য্যের অধিকারী সবুজ পাহাড়ে ঘেরা এই লেককে প্রাকৃতিক হ্রদ মনে করে অনেকেই।কিন্তু এটি একটি মানবসৃষ্ট হ্রদ বা কৃত্রিম হ্রদ।চট্টগ্রামের পানি সমস্যার সমাধানে ১৯২৪ সালে প্রায় ৩৩৬ একর জায়গায় কৃত্রিম এ হ্রদ খনন করেছিল আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃকপক্ষ। এই লেকটি বেঙ্গল রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার ফয়েজ মূলত খাবার পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে তৈরী করেন। এটি জিরো পয়েন্ট থেকে ৮কিমি দূরে অবস্থিত। ফয়েজ লেক একটি সংকীর্ণ উপত্যকা জুড়ে অন্য এক পাহাড় থেকে বাঁধ নির্মাণ করে তৈরি করা হয়েছে।তাঁর নামানুসারে হ্রদটির নাম হয় ফয়েজ লেক।

চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে থেকেও অযত্ন আর অবহেলায় সৌন্দর্যহীন পড়েছিল এই প্রাচীন লেক। ২০০৫ সালে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আঁকাবাঁকা এই লেকের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও রিসোর্ট।যা বর্তমানে নগরীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র।







লেকের দুইপাশে সবুজে ঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড়। পাহাড়গুলোর নাম রাখা হয়েছে আসমানী, গগনদ্বীপ, জলটুঙ্গি ইত্যাদি।পাহাড়ের সংরক্ষিত বনে হরিণ, খরগোশ সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আছে।এছাড়া লেকের বাঁক অনুসারে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর নাম দেয়া হয়েছে,যেমন অরুনাময়ী, গোধূলী, আকাশমনি, মন্দাকিনী, দক্ষিণী, অলকানন্দা।







প্রকৃতির নির্জনতায় সময় কাটানোর জন্য রিসোর্টটি বেশ।লেক ও পাহাড়মূখী দু ধরনের রুমই আছে দুইধরনের দামে। এছাড়া বাংলোয়ও থাকার ব্যবস্থা আছে।বারান্দায় বসে কফি আর বই নিয়ে লেক আর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগে করতে করতে একটা বিকেল পেরিয়ে কখন যে সন্ধ্যে হল টেরই পেলাম না।







ডিনার শেষে আমরা কেক কাটার জন্য নৌকায় করে জেটিতে চলে এলাম।নৌকার জন্য 20 মিনিট আগে বলতে হয়। রিসোর্টের অতিথিদের জন্য এই সার্ভিস ফ্রি।এখানে রেস্টুরেন্ট লেকের পাড়ে খোলা আকাশের নীচে খাবারের ব্যবস্থা করেছে।আমাদের মত অনেকে নতুন বর্ষকে স্বাগতম জানাতে কেক ফানুস, বাজি নিয়ে এসেছে।নৌকায় রাতে ফেরার পথে চাঁদের আলো আর পাহাড়ের ছায়া লেকের জলে পড়ে যে চমৎকার দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে, তা বলা বা ক্যামেরায় ধারন করা যাবে না। এটা শুধু মনের এলবামেই রাখা যায়।





আমি রাতেই গুগোল দেখে জেনে নিয়েছিলাম স্থানীয় সূর্যাদয়ের সময়, এবং সেভাবে ভোর 6 টায় নৌকার জন্য বলে রেখেছি রিসিপসনে।ভোরে আমি নৌকায় ওঠার আগে ভালো করে জেনে নিয়েছি নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে, কারন আমি একা যাচ্ছি ওপাড়ে সূর্যাদয় দেখতে আর ছবি তুলতে।আমাকে নিশ্চিত করেছে তারা যে নিরাপত্তা টাওয়ার থেকে সর্বক্ষণ নজরদারী করা হয়, এবং গানম্যান আছে।শুধু সতর্ক থাকতে হবে সাপ নিয়ে।ভোরবেলায় লেকের পানিতে সাপের বিচরণ দেখে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের কথার সত্যতা পাওয়া গেল।তবে পানকৌড়ির ডুব সাঁতার আর বক, মাছরাঙা সহ বিভিন্ন পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত ছিলস্নিগ্ধ প্রকৃতি।রিসোর্ট কর্তৃপক্ষও যথেষ্ট আন্তরিক পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে, তাই প্রকৃতি এখানে এতটা সজীব এখনো।এখানের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে চট্টগ্রাম শহরের বার্ডস আই ভিউ দেখা যায়।







প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ ছাড়াও এখানে বেশ কিছু আধুনিক রাইড আছে থিম পার্ক অংশে, যা ছোট বড় সব বয়সী মানুষকে আকর্ষণ করে।যেমন,সার্কাস সুইং, বাম্পার কার, বাম্পার বোট, ফ্যামিলি রোলার কোস্টার, জায়ান্ট ফেরিস হুইল, ড্রাই স্লাইড, ফ্যামিলি ট্রেইন, প্যাডেল বোট, ফ্লোটিং ওয়াটার প্লে, পাইরেট শিপের মতো আনন্দদায়ক সব রাইড।

এছাড়া লেকে ভ্রমণেরও নানান আয়োজন আছে। নানান আকারের ইঞ্জিন চালিত ফাইবার-বোট, স্পিড-বোটসহ আছে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নৌকা ও সাম্পান। আধা ঘণ্টা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে লেকে ভ্রমণ করা যায়।











আমি অবশ্য সকালবেলা লম্বা সময় ক্যামেরা নিয়ে পুরো এলাকা পায়ে হেঁটে ঘুরেছি।

রিসোর্টে আসার দিন খেয়াল করিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভটি।সাদামাঠা ভাবে করা তাই নজরে আসেনি, যদিও ইতিহাস আমার জানা ছিল।অনেকেই হয়তো জানেন না, ফয়েজ লেক দেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি গুলোর মধ্য একটি। একাত্তরে ফয়’স লেক এলাকা জল্লাদখানা হিসেবে পরিচিতছিল।মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ রোজায় ট্রেন থেকে ধরে এনে প্রায় 5/6হাজার নিরীহ বাঙালীকে নির্বিচারে গুলি ও জবাই করে হত্যা করেছিল পাকবাহিনী, স্থানীয় বিহারি-পাঞ্জাবি ও তাদের এদেশীয় রাজাকার,আলবদররা।এছাড়া রেলওয়ে কলোনি ও চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে ধরে এনে নির্যাতন করে মারা হত এখানে।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে শুধু একটা গর্ত থেকেই প্রায় 11 শত মাথার খুলি উদ্ধার হয়।এতে করে অনুমান করা যায় কত হাজার মানুষ এখানে শহীদ হয়েছেন।এই বধ্যভূমি সংরক্ষনের উদ্যোগ নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দীন সহ ৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি আপিল দায়ের করেছিলেন2012 সালে।আদালত 2014 সালে সংরক্ষনের পক্ষে রায় দেয়।তাই হয়তো ছোট করে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে, রিসোর্টের প্রবেশ পথে যেখানে গাড়ি থামে।

শহরের যান্ত্রিক জীবনের ছকে বাঁধা রুটিনকে সাময়িক ছুটি দিয়ে ঘুরে আসতে পারেন প্রকৃতির এই নির্জনতায়।সবুজাভ পানি আর সবুজ পাহাড় আপনার সাথী হবে।পাখি আর ঝিঁঝিঁ পোকার গান তো বাড়তি পাওয়া।















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post