একপাশে পাহাড় আর অন্য পাশে ঝাউবন আর গাছ গাছালির মাঝ দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। কখনো ঝাউগাছের ফাঁক দিয়ে সাগর কাছে আসে, কখনো বা দূরে যায়। কক্সবাজার থেকে প্রায় 18/20 মিনিট চলার পর গাড়ী মারমেইড রিসোর্টের দিকে বাঁক নিল। রাস্তার উপর থেকে বোঝা উপায় নেই রিসোর্টের উপস্থিতি, শুধু সাইনবোর্ড ছাড়া।
কোভিড জনিত কারনে অভ্যর্থনার রীতি রেওয়াজে অনেক পরিবর্তন এসেছে,সেটা ঘর থেকে শুরু করে সরকারী অফিস, কর্পোরেট অফিস বা রেস্তোরা থেকে রিসোর্ট,সব জায়গাতেই।আর মারমেইড রিসোর্ট সব কিছুতেই আলাদা তা আমরা গাড়ী থেকে নেমেই টের পেলাম।করোনা জনিত সব হোটেল, রেস্তোরা দুর থেকে জ্বর মাপা মেশিন ধরে আর হাতে স্যানিটেশন লোশন একটু দিয়ে দেয়।এরা বাহিরে রাখল বেসিন যাতে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া যায়। রিসোর্ট কর্মীরা বিনয়ের সাথে দেখিয়ে দিচ্ছে হাত ধুয়ে জীবাণুনাশক দিয়ে ভেজানো পাপোশে পা রেখে রিসোর্টের দিকে এগিয়ে যেতে।এই সময় তাদের সময়োপযোগী ব্যবস্থা আমার বেশ ভালো লেগেছে। আমি এই রিসোর্টে আগেও কয়েক বার গিয়েছি।তখন একটু ভিন্ন ভাবে বুনো ফুলের মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতো।
খানিক দূর হাঁটতেই আমাদের স্বাগতম জানালো তবে এবার মালা দিয়ে নয়, হাতে কিছু এমাজন লিলি আর জবা দিয়ে।খুব দ্রুততার সাথে সব আনুষঙ্গিকতা শেষ করলো।এর মাঝে অভ্যর্থনা কর্মীরা মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাদের হাতে দিয়ে গেল ডাবের পানির গ্লাস।এটাই আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংকস।বাংলাদেশে সাধারণত ওয়েলকাম ড্রিংকস বলতে তথাকথিত টং দেয়া হয়,যা দেখলেই খাওয়ার ইচ্ছে চলে যায়।তবে দেশের বাহিরে অবশ্য সবসময় ওয়েলকাম ড্রিংকসে ভিন্নতা থাকে, পরিবেশনেও থাকে নান্দনিকতা।
১২ একর জায়গার ওপর তৈরি এই রিসোর্টের ভেতরে সরু পাকা আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগুলেই চোখে পড়ে গাছপালার আড়ালে থাকা ছোট-বড় অনেক কুটির। এখানকার থাকার ঘরগুলো ছাদ-চালা, বাঁশ ও ছন দিয়ে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন তা গাছপালা গুলোর উচ্চতাকে ছাড়িয়ে না যায়।রাস্তার দুপাশে সাজানো মাটির পাত্রে পানির ওপর ফুল ভাসানো আছে, যাতে গাছগাছালির ফাঁকে গলে আসা রোদ আলো ছায়া লুকোচুরি খেলছে।সাথে রাতের জন্য আছে দৃষ্টনন্দন বাতি।
প্রকৃতি ও আধুনিকতার সমন্বয়ে পরিবেশ সম্মত ও প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি কুটির গুলো মূলত ইকো ট্যুরিজমের কনসেপ্ট মাথায় রেখেই করা হয়েছে। ইট-পাথরের দালানের অভ্যস্ততা থেকে কয়েকটা দিনের ছুটি নিয়ে গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নিতে পারেন এমনবাঁশ, কাঠ ও ছনের তৈরি কটেজগুলো শান্তির নীড়ে।
কুটিরগুলোর জানালা ও দরজারগুলো অনেক বড় করে তৈরি যাতে অতিথিরা সুনির্মল বাতাস এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।কুটির গুলোর নামেও ছিল বৈচিত্র্য।আমাদের কুটিরের নাম ছিল লাভার স্কুইড।প্রতিটি নাম এমনই বিচিত্র ছিল।
বাহির থেকে স্রেফ কুটিরের মতো দেখালেও ভেতরে কিন্তু আধুনিক।বিশেষ করে স্নান ঘরের ডেকারেশন আমার বেশ পরিপাটী লেগেছে, প্লাস্টিকের বোতলে ভর্তি বাজারি শ্যাম্পুর বদলে কাচের পাত্রে ভেষজ উপায়ে বানানো শ্যাম্পু। সেটা আবার সবুজ গাছের পাতা দিয়ে কায়দা করে ঢাকা। দুই পাশে দুটো কাঠগোলাপ ফুল গুঁজে দেয়া। সাবান, শ্যাম্পু রাখা ছিল নারকেলের লম্বা একটা খোলের মধ্যে।এছাড়াও ইয়োগ সেন্টার, স্পা,সম্মেলন কক্ষ, প্রেক্ষাগৃহ সবকিছুরই ব্যবস্থা আছে এ পরিবেশবান্ধব অবকাশ যাপন কেন্দ্রে,যা একটা আধুনিক রিসোর্টে থাকে।ছোট্ট স্যুভেনির শপও আছে এখানে।যেখান থেকে দেশীয়, বার্মিজ এবং কক্সবাজারের স্থানীয় স্মারক কেনা যায়।
দুপুরের খাবারের জন্য ছিল কয়েক ধরনের বসার ব্যবস্থা।এসি রেস্টুরেন্ট, খোলা জায়গায় গাছের নীচে বালুর উপর পাতা টেবিল চেয়ার আবার ছাউনি দেয়া চারপাশ খোলা রেস্টুরেন্টও ছিল।আমরা খোলা রেস্টুরেন্টে বসলাম সমুদ্রের বাতাসে বসে সামুদ্রিক মাছের স্বাদ নেবার জন্য। যদিও আমি মাছ খাই না।তাই আমার জন্য স্পেশাল সবজী ডিস দেয়া হল।তবে খাবার গুলোর পরিবেশনে এত বৈচিত্র্য ছিল যে আমি বসে বসে সবগুলো খাবারের ছবি তুলেছি।
মারমেইড রিসোর্টের বড় আকর্ষণ হলো নিজস্ব সমুদ্র সৈকত। রিসোর্টের সামনেই আদিগন্ত সমুদ্র; বলতে গেলে ঘর থেকে বের হলেই।
রোদ কিছুটা কমলে কুটিরের সামনের বাঁশের বেঞ্চে গা এলিয়ে দিয়ে সমুদ্র গর্জন আর বাতাসের মিলিত কণ্ঠে মন মাতাল করা গান শুনলাম।বিকালের দিকে অনেকই নৌকা ভ্রমণে বের হয় রেজু খালে।
বিকালবেলা একা বের হলাম আমার ক্যামেরা নিয়ে, খেয়াল করলাম সৈকতের বালুর উপর এখানে-সেখানে অনেক বসার জায়গা,তা আবার বিভিন্ন আকৃতির।যেন যেখান থেকে ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে, যখন ইচ্ছা সাগরের গান শোনার সব ব্যবস্থা করা আছে।এছাড়াও আছে লেখার টেবিল, ছবি আঁকার জন্য ইজেল।এক জায়গায় ছোট করে লাইব্রেরীর মত কিছু বই রাখা আছে,যা আমার কাছে সবচেয়ে বেশী ভালো লাগলো।আরো আছে ছবি তোলার বিশেষ ফ্রেম, হানিমুন কাপল বা তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে এই আয়োজন।অবশ্য এতে তাদের বিজ্ঞাপনের কাজও হয় সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে।আরেকটা বিষয় নজরে পড়ল,জায়গায় জায়গায় অসংখ্য প্লাগ পয়েন্ট, যেন কোনকিছুতে চার্জ দিতে হবে বলে আড্ডায় বা গল্পে বিঘ্ন না ঘটে। হাঁটতে হাঁটতে নারকেল গাছ পেরিয়ে রেজু খালের পাড় ধরে বেশ খানিক চলে গিয়েছিলাম।রেজু খালের পানি কিছুটা নীলচে রঙের।সাগরের শাখাই বলা যায় রেজু খালকে।পাশ দিয়ে ভেসে যায় বাহারি সাম্পান।ভেজা বালুতে একটু পর পর ছোট ছোট ছিদ্র দেখে আমি বুঝেছি লাল কাঁকড়ার আবাস্থল এখানে।আগে কলাতলী ও ইনানী বীজে হরহামেশাই দেখা যেত।পরিবেশ দূষণের কারনে এখন আর দেখা যায় না।একটু চুপ করে দাঁডিয়ে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি দেখলাম।
ঝাউগাছ গুলো দখিনা বাতাসে এমন ভাবে মাথা দোলাচ্ছিল যেন মাথা নেড়ে আনন্দের সাথে অভিবাদন জানাচ্ছে।নির্জন সাগরতীরে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে কোন ফাঁকে বেলা পেরিয়ে গেল টেরই পেলাম না।ফিরতে ফিরতে দিগন্ত জুড়ে লাল রং ছড়িয়ে সূর্যমামা বিদায় বেলার জানান দিচ্ছিল।শেষ গোধূলির রঙে সন্ধ্যা ঘনানো আলো আর মাতাল বাতাস যেন কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে গেল ফেরার সময় হল বলে।
রাতের খাবারের পর বোট ক্লাবের পাটাতনে পেতে রাখা চেয়ারে বসে সাগরের ঢেউের উপর চাঁদের রূপালী আলো তীরে এসে লুটিয়ে পড়া দেখতে দেখতে আপন খেয়ালে সুর বেসুরে গান গাইলেও সমস্যা নেই।কারন একটু দূরে দূরে পাতা চেয়ার অন্য যারা আছে তাদের মনও এখন মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে নেই।যেমনটা আমারও ছিল না।আশ্চর্য মৌনতায় ডুবে ছিল সমস্ত এলাকা।গভীর রাত পর্যন্ত বসে ছিলাম, মনে হচ্ছিল প্রতি দিনই ঘড়ি ধরে ঘুমাই- জাগি, একরাত না হয় সাগর আর চাঁদের আলোর লুটোপুটি দেখে কাটিয়েই দিলাম।
অভ্যাসমত ভোরবেলায় উঠে গেলাম সূর্যাদয় দেখবো বলে।আমার মনে হয় সূর্যোদয় মানুষকে ভাবতে শিখায় নতুন শুরুর কথা, পুরানো দুঃখ কষ্ট ভুলে নব আনন্দে মন প্রাণ জাগাতে।তবে বেড়াতে গেলে ভোরে উঠি অবশ্য একই স্থান বা শহরের ভিন্ন রূপ দেখতে।কক্সবাজারে এলে অবশ্য ভোরবেলায় নিরাপত্তা জনিত কারনে বাহির হই না, জানালা দিয়ে যতদূর সম্ভব দেশি,কফি মগ নিয়ে বারান্দায় বসি।এখানে নিরাপত্তা সংকট নেই তাই বের হলাম ক্যামেরা নিয়ে।আকাশে কিছু পাখির এলোমেলো উড়াউড়ি দেখতে দেখতে, হঠাৎ মনে হলো কোনো ষোড়শী লজ্জা পেয়ে গাল লাল হয়ে যাওয়ার মতো মেঘের একটা কিনারা লাল হয়ে উঠেছে। ঠিক লাল নয়, কমলা।সূর্যের আলতো রশ্মি এসে পড়েছে মেঘের গায়ে। এতটাই মৃদু আলো যে, মেঘ ভেদ করে সে আলো এপারে আসতে পারছে না। সেই সাদা মেঘের উপর কমলা রঙের আভার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত।কোনো ক্যামেরারই সাধ্য নেই সে ছবি তোলার।কারন মানুষের চোখে লেন্স কোন জিনিশ বা রং কে যে নিখুঁত ভাবে দেখতে জানে ক্যামেরা তা লেন্সে ধরতে পারেনা।কোনো কবি হয়তো পারবেন ওই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে।
শহরের ব্যস্ততায় কান্ত মানুষ চায় যান্ত্রিক কোলাহল ও নাগরিক ব্যস্ততা মুক্ত অবকাশ।মোটামুটি সব আয়োজনই আছে এখানে।এককথায়, প্রকৃতির সান্নিধ্যে বা সমুদ্রের মৃদু মন্দ হাওয়ার সাথে অপার নির্জনতার আবেশে মনকে সতেজ ও প্রাণবন্ত করে তুলতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন মারমেইড ইকো রিসোর্টে।
_
0 মন্তব্যসমূহ