up

#রাজকীয় সমুদ্র ভ্রমণ


সমুদ্রের বিশালত্বে নিজেকে হারানো বা অবকাশ যাপনের জন্য যে কোন ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের কাছে বিলাসবহুল জাহাজে সমুদ্র ভ্রমণ হলো অনেকটা স্বপনের মতো সুন্দর।এমন একটা বিলাস বহুল জাহাজ Dream Cruises এ আমার সিংগাপুর থেকে মালাক্কায় বেড়ানো সুযোগ হয়েছিল গতবছর।


আমাদের এমন বিলাসবহুল নৌভ্রমণের অভিজ্ঞতা না থাকায় আমরা কিছুটা দেরী করে মেরিনা বে ক্রুজ সেন্টারে পৌঁছেছি। গাড়ী থেকে নেমেই বাহিরেই লাইনে দাঁড়াতে হল জেটিতে ঢোকার জন্য।তখনো ডিপার্টসারের প্রায় তিন ঘণ্টা বাকী।তারপরও দীর্ঘলাইনের পেছনে পড়েছিলাম আমরা।পাসপোর্ট ও বুকিং এর কাগজপত্র যাচাই করে আমাদের লাগেজ ড্রপ করতেই এক দেড় ঘণ্টা লেগেছিল।এরপর জেটিতে গিয়ে জাহাজে উঠার জন্য অপেক্ষা।জেটিতে আমাদেরকে নাম, রুম নাম্বার সহ আইডি দেয়া হল,যা রুম কী হিসেবেও কাজ করবে।


মেরিনা বে ক্রুজ সেন্টার এতটাই সুন্দর করে গোছানো যে আমাদের মতো কোন কোন দেশের এয়ারপোর্টে চেয়ে পরিষ্কার।বসার ব্যবস্থা,ক্যাফে এবং খোলামেলা পরিসর থাকায় এখানে ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করলেও বিরক্তি লাগে নাই।


দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত ডাক, যাত্রীদের দুইভাগে লাইন করেছিল।এক লাইনে শুধু ভারতীয়রা,আরেক লাইনে বাকী সব দেশের মানুষ।তবে আমার কাছে মনে হল, সবচেয়ে বেশী চাইনিজ,দ্বিতীয় ভারতীয়।

হঠাৎ করে 'ইধার আও,ইধার আও,ইন্ডিয়ানকে লিয়ে ইধারছে' বলে লাইনে দাঁড়ানো এক ভদ্র মহিলা আমাকে ডেকে তার সাথে যেতে বলছিল।আর আমি হেসে তাকে পাসপোর্ট দেখিয়ে বুঝালাম, আমি ইন্ডিয়ান নই।তাই তার আর আমার লাইন আলাদা।ভদ্র মহিলা কিছুটা অবাক হল।দেশের বাহিরে বেড়াতে গেলে আমাকে সবাই ভারতীয় ভাবে। এই সমস্যা সবসময় হয়। মাঝেমাঝে ভারতীয় ভাবায় সুবিধে পাই,যেমন কেউ কেউ যেচে কথা বলে যে আমার কান্ট্রিতে ভিজিট করেছে,দোকানদান বা সেলসম্যান ডিসকাউন্টও দেয়,সেও ভারতীয় বলে।একবার তো এক ট্রেভেল গাইডকে মজা করে শারুক খান বলায় সে বেশ ভালো ডিসকাউন্ট দিয়ে দিলো শারুক খান হওয়ার খুশীতে।



জেটির লম্বা করিডোর পার করে জাহাজের গেট দিয়ে ঢুকার পথেই সিকিউরিটি চেক হল এবং পাসপোর্ট জমা রেখে দিলো।পাসপোর্ট জমা দিতে কেমন যেন খচখচ লাগছিল,কারন বিদেশে পাসপোর্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যদি এত এত পাসপোর্টে মাঝে মিসিং হয়ে যায়! কিন্তু নিয়ম এটাই।জাহাজ থেকে কেউ যেন কোথাও না যেতে পারে।অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে এই নিয়ম।




আমাদের রুমটি ছিল 14 তলায়।হোটেলের রুমের মতো বড় না হলেও দুজনের তিন দিন, দুই রাত স্বাচ্ছন্দ্যে কাটানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিসর ছিল।বাথটাব সহ উন্নত বাথরুম এবং কিং সাইজ বেড, ফ্রীজ,লকার,কফি মেকার সহ ফাইভ স্টার স্ট্যান্ডাড হোটেলরুমের মতোই সুযোগ সুবিধে ছিল।আমাদের রুমের সাথে একটা ব্যালকনি ছিল।ব্যালকনিটি বড় না হলেও দুজন মানুষ বসে গল্প করতে বা কফি খেতে খেতে দিগন্ত বিস্তৃত সাগরের নীল জলে মন হারানোর জন্য যথেষ্ট। 



সমুদ্রের লোনাজলের গন্ধ আর মন মাতাল করা বাতাসের সাথে মিতালী করেই বিকাল কেটে সন্ধ্যা হল।জাহাজ ততক্ষণে সিংগাপুরের মাটি থেকে অনেক দূরে, তখন খেয়াল হল আমরা নেটওয়ার্কের বাহিরে।রুম সার্ভিসে ফোন করে জাহাজের নিজস্ব ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে ছিলাম।স্পীড ভালো ছিল না,ইমেল চেক এবং প্রয়োজনীয় ফোন কল করা গিয়েছিল কোন মতে।






আমাদের লাগেজ না আসায় রাতের আটটার দিকে ইনফরমেশন ডেক্সে কল দিলে ওরা জানালা ঘণ্টা খানেক লাগবে, তারা পৌঁছে দিবে।ভুল আমাদের হয়েছে,আমরা কোন ছোট ব্যাগ আনি নাই নিজের সাথে।সবার উচিৎ ছোট একটা সহজে বহনযোগ্য ব্যাগ আনা,যাতে জরুরী জিনিশ ও 1/2 টা কাপড় নেয়া যায়।ব্যাগ পেতে রাত 10টার বেশী বেজেছিল। আবার ফেরার আগের রাতেই লাগেজ দিয়ে দিতে হয়।



যাত্রীদের আলাদা খাদ্যাভ্যাসের জন্য চারটা রেস্টুরেন্ট বা ডাইনিং হল রাখা হয়েছিল।চাইনিজ,ইন্ডিয়ান, আন্তর্জাতিক এভাবে ভাগ করা হয়েছে।একজন যাত্রী যে কোন এক ডাইনিং এ ইচ্ছে অনুসারে খেতে পারবে বুফে।আমরা ইন্ডিয়ান ফুড বেছে নিলাম।

বিলাসবহুল এই জাহাজে হেলিপ্যাড,সিনেমা হল, আধুনিক ক্যাসিনো,স্পা,লাইভ মিউজিক সহ বার,জীম,লটারি জোন এবংবোলিং,বিলিয়াট সহ অন্যান্য ইনডোর গেমেরও ব্যবস্থা ছিল।যাত্রীদের বিনোদনের জন্য দুইটা সিনেমা হলে রাতদিন টানা মুভি চলছিল।বিঙ্গো সহ অন্যান্য লটারি গেম গুলোতে ভালো ভালো গিফট থাকায় শুধু ছোটরা নয় বড়রা ভীড় করেছে।ডিনারের পর পুল পাড়ে লাইভ মিউজিকের আয়োজন ছিল, সাথে পর্যটকদের নাচ ফী। হোক না, তাল লয় বিহীন।এছাড়াও আধুনিক সুইমিংপুল সহ ওয়াটারস্লাইড পার্ক ছিল।বাস্কেটবল কোর্ট, মিনি গল্ফ, রক ক্লাইম্বিং, রোপস কোর্স, জগিং ট্র্যাকও ছিল। এমনকি বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের পোশাক, ঘড়ি, হাতব্যাগ, জুতা, জুয়েলারি, সানগ্লাসের আউটলেট ছিলো।যদিও কেনাকাটার চেয়ে দেখার বা সময় কাটানোর জন্যই বেশী মানুষ সপ গুলোতে ঢুকতো।আর এই সব সুযোগ সুবিধে স্বাচ্ছন্দ্যে উপভোগ করার জন্য ছিল 18টালিফট।





এককথায় সমুদ্রে ভেসে থাকা সত্ত্বেও এতে ছিল আধুনিক সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। আমার কাছে 18 তলার ঔ জাহাজকে ছোটখাটো একটা চলন্ত শহর মনে হয়েছিল।

জাহাজের কর্মীদের আচরণে পেশাদারিত্ব দক্ষতা ও দায়িত্ববোধ।কয়েক হাজার পর্যটক,বিভিন্ন দেশের,বিভিন্ন সংস্কৃতির।টিকেট ক্যাটাগরিও চার রকম। সব এত সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, মোটেও সহজ কথা নয়।তারপরও প্রতিটি কর্মী হাসি মুখে যাত্রীদের প্রয়োজন মিটিয়েছে।বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট এবং পুল ও রাইডস গুলোর কর্মীদের ধৈর্য ছিল অবাক করার মত।




নীল জলরাশি ও আকাশের মিতালি উপভোগ করার জন্য জীবনে একবার হলেও এমন প্রমোদতরীর আতিথেয়তার স্বাদ নেয়া উচিৎ সুযোগ ও সংগতি থাকলে। প্রমোদতরী শব্দটি উচ্চারিত হলেই মানুষের চোখের সামনে যেমন ভেসে ওঠে বিশালাকৃতির জাহাজ।আমার মনে হয়,এমন নৌভ্রমণ শেষে যে কারো কাছে 'প্রমোদতরী' শব্দটিকে বিশালতা আর রাজকীয়তার প্রতীক মনে হবে।








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post