up

# ঐতিহাসিক শহর মালাক্কায় কয়েক ঘণ্টা


নীল জলের আর আকাশের মিতালি উপভোগ করার জন্য রাজকীয় আয়োজনে সমুদ্র ভ্রমণ প্রতিটি ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত। বিশেষ করে আরামপ্রিয় পর্যটকের কাছে তো স্বর্গতুল্য।সমুদ্রের বিশালত্বে নিজেকে হারানোর মতো অবকাশ যাপনের জন্য এমন একটা বিলাসবহুল জাহাজে আমারও সুযোগ হয়েছিল সিংগাপুরের মেরিনা বে থেকে তিন দিন দুই রাতের জন্য সমুদ্র বিহারে যাওয়ার।
আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসহ ভাসমান এই শহরে যাত্রীদের বিনোদন বা আমোদ-প্রমোদের সব আয়োজন থাকায় বেশীরভাগ পর্যটক পুরো সময় প্রমোদতরীর আতিথেয়তা উপভোগে ব্যস্ত ছিল।অল্প সংখ্যক পর্যটক সিটি ট্যুর বুক করেছে।স্টুডেন্ট লাইফে ভূগোল বইয়ে মালাক্কা প্রণালী পড়ে মালাক্কার অতীত ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখবার উদ্দেশ্যে আমি মালাক্কা সিটি ট্যুর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।







সমুদ্রে নোঙ্গর করা জাহাজ থেকে ছোট বোটে করে নীলাভ জলরাশির অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা পৌঁচ্ছে গেলাম মালাক্কা পোর্টে।পোর্টের এক কর্মচারীকে আমাদের বোর্ট ফেরার সময় জানতে চাইলে সে আমাকে হিন্দিতে বললো 'এক ঘন্টা বাদ মে'। আমি তাকে হেসে আবারও ইংরাজিতেই বললাম আমি ভারতীয় না। আমি বাংলাদেশী। সে জানতে চাইল 'তুমি কোন ভাষায় কথা বল' 'বাংলা' বলতেই বলল, 'এক ঘণ্টা পর পর তোমার বোর্ট আসবে'।ভিন্ন ভাষীর মুখে বাংলা শুনে মজা পেলাম। তাকে 'ভাষা বিশেষজ্ঞ' উপমা দিলাম মুচকি হাসি দিয়ে।তারপর আমরা এগিয়ে যেতেই একদল ঢাকি আমাদেরকে বাজনা বাজিয়ে অভ্যর্থনা জানালো।যেন আমরা ভিআইপি কোন অতিথি।ঢাকিদের চেহারা এবং পোশাক অনেকটা তামিলদের মত লেগেছে আমার কাছে।এই পোর্টের রেওয়াজ অতিথিদের এই ভাবে অভ্যর্থনা জানানো।তাদের কাছে পর্যটকেরা লক্ষ্মী এবং অর্থনীতির প্রাণ।মালাক্কা মূলত পর্যটক নির্ভর সিটি।





মাল্লাকায় ঢুকতে আমাদের কোন ভিসা, পাসপোর্ট লাগেনি। শুধু আমাদের গলায় জাহাজ কর্তৃপক্ষের দেয়া আইডি বা 'রুম কী' টাই ছিল।মালাক্কা বন্দর কর্তৃপক্ষ কোন রকম সিকিউরিটি চেকও করেনি।আমরা বের হওয়ার পর একজন লোক এসে তালিকা ধরে নাম ডেকে বাসে তুলল আমাদের।তারপর বাসে করে রওনা হলাম মালাক্কা সিটির উদ্দেশ্যে।বন্দর থেকে বের হওয়ার মুখেই একটা পুরানো চার্চ পড়ল সামনে।বর্তমানে জৌলুসহীন হলেও তার অবস্থান বলে দিচ্ছিল এখানকার এককালের বাসিন্দাদের ধর্মীয় পরিচয় বা আর্থিক সামর্থ্যের ইতিবৃত্ত।





গাড়ীতে যাওয়ার সময় রাস্তায় কোথাও সংরক্ষিত বন,কোথাও পাম বাগান,কোথাও ঝাউবাগানের ফাঁকে ফাঁকে সাগরের উঁকিঝুঁকি দিতে দেখলাম।কোথাও বা পাহাড়ের পাদদেশে একা দাঁড়িয়ে থাকা একটা মন্দির বা মুর্তি।এক জায়গা তো হঠাৎ রাস্তায় অনেক বানর নেমে এল। তাদের জন্য কলা ছুড়ে দিয়ে রাস্তার বাহিরে,তবেই গাড়ী এগুতে হল।প্রস্তুতি দেখে বুঝেছি, এটি নৃত্য ঘটনা ড্রাইভার বা গাইডের জন্য।কিন্তু পর্যটকদের জন্য নতুন।তাই সবাই কৌতূহল নিয়ে মজা দেখছিল।মালয়েশিয়ার বড় বড় প্রদেশ গুলোর রাস্তার মতো এই রাস্তা প্রশস্ত নয়।তবুও যানজট মুক্ত রাস্তাটা আমার ভালোই লাগছিল।সাথে গাইডের মালাক্কার আদিঅন্ত বিবরণ তো আছেই।

_



আমাদের গাইড ইতিহাসবেত্তার মতো মালাক্কার বর্ণনা দিতে শুরু করার আগে যাত্রীদের দেশ জানতে চাইল।নিজে দেশের নামবলে জানতে চাইল কতজন সে দেশের আছে, হাত তুলতে।চীন বলার 10/12 জন হাত তুলল।আমার মনে হল চীন,আর অস্ট্রেলিয়ার পর্যটক বেশী ছিল।সে ভারতের নামও বলল।ভেবেছিলাম তারপর বাংলাদেশ বলবে, কিন্তু বলল না।শেষে আমাদের দুজনের দেশ জানতে চাইলে বাংলাদেশ শুনে, কিছুটা অবাক হল। বলল প্রথমবার সে কোন বাংলাদেশী পর্যটক পেয়েছে।আমরা নিজেরাও সীপে কোন বাংলাদেশী পাই নাই।থাকলে নিশ্চয় ডাইনিং এ দেখা হয়ে যেতো।আর ভারতীয় পর্যটকেরা বেশী জাহাজ থেকে বের হয়নি,যারা এই ডে টু্র নিয়েছে,তারাও মালাক্কার চেয়ে পেনাং বা কয়াল্লামপুরে নিদিষ্ট স্পর্ট ফটো সুট নিয়েছে।আমরা ইতিপূর্বে দুইবার কুয়ালালামপুর যাওয়ায় আমাদের আগ্রহ ছিল না।এছাড়াও আমার ঐতিহাসিক স্থানের প্রতি আগ্রহ ছিল বেশী, তাই আমি মালাক্কা নিয়েছিলাম।





ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ মালাক্কাকে মালয়েশিয়ার ইতিহাসের শহর বলা যায়। আসল নাম মেলাকা হলেও সবাই মাল্লাকা নামেই চিনে। মালাক্কাকে অনেকে মালয়েশিয়ার আন-অফিশিয়াল রাজধানীও বলে থাকেন। ১৯৫৭-এ স্বাধীনতাঘোষণার আগ পর্যন্ত এই শহর পর্তুগিজ, ডাচ, জাপানি ও ব্রিটিশরা শাসন করেছে।তাই এখানে সেই সময়কার অনেক নিদর্শন এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। মালয়েশিয়ার অন্য শহরের মত হাইরাইজ ব্লিডিং বা কৃত্রিম চাকচিক্য এখানে নেই, তবে সাজানো গোছানো, পরিপাটি এই শহর। প্রত্যেক জায়গায়ই একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। মালাক্কাও এর ব্যতিক্রম নয়।এখানে নাগরিক কোলাহল তেমন একটা নেই।শান্ত নিরিবিলি শহর।







প্রায় ১১ বাজে আমরা বাস থেকে নামি একটা মলের সামনে।আমাদের গাইড আমাদেরকে রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছে,বাসে ফেরার সময় আর স্থান বলে দিয়ে।তারপর সবাই যার যার মত ঘুরতে লাগল।





গাইডের গাড়িতে মালাক্কার বর্ণনায় জেনেছিলাম মালাক্কা নদীর কথা।একটু খানি হাঁটলেই মালাক্কা নদীর বোট জেটি পড়ে।এখানে একটি বড় কাঠের জাহাজ ছিল, যেটি মালাক্কার বাণিজ্যিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে।নদীর পাড় বাঁধানো, প্রশস্ত ওয়াকওয়ে, গাছপালা দিয়ে সাজানো। নদীতে বেড়ানোর জন্য ছোট ছোট ওয়াটার বোট ছিল। প্রায় 30/35 জনের সিটের এই ওয়াটার বোটে উঠার জন্য আমরা টিকেট কেটে অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ।কিছু সময় পর পর বোট গুলো ছেড়ে যায়।আমাদের নিয়ে বোটটা যখন চলতে শুরু করলে পর্যটকেরা নিজেদের এবং আশপাশের ছবি তুলতে ব্যস্ত।আমিও কিছু ছবি তুললাম দুইতীরের ঘরবাড়ীর।ঘর বাড়ীর স্থাপত্যশৈলীর সাথে ভারতের গোয়ার এবং শ্রীলংকার নুয়ারা এলিয়ার মিল খেয়াল করলাম।যা মূলত পর্তুগীজ স্থাপত্যকলার ধারক।একটা মসজিদ দেখলাম যেন পানিতে ভাসছে। মসজিদটির নাম ‘মসজিদ সালাহ মালাকা’।বেশ সুন্দর।

শান্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই নদীকে দেখে মনে পড়ল আমাদের বুড়িগঙ্গার কথা।অনেক দেশেই সিটির ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী বা খালকে সংরক্ষণ করা হয় পরিবেশগত ও সৌন্দর্যগত কারনে।আর সেই নদী হয়ে ওঠে পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র। কিন্তু আমাদের ঢাকা সিটির চারপাশের নদী তো দূরের কথা,মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গায়ই বিষাক্ত করে ফেলা হয়েছে।বুড়িগঙ্গায় এখন পর্যটক তো দূরের কথা স্থানীয় মানুষই বাধ্য না হলে নৌকায় পারাপার হয় না।এই ব্যর্থতা আমাদের নগর কর্তৃপক্ষের।আরমালাক্কা শহর কর্তৃপক্ষ তার সম্পূর্ণ উল্টো।তারা এই নদীর যত্ন নিতে এতটুকু কাপর্ণ্য করেননি। দুই পাড় বাঁধাই করে সবুজায়ন করেছে, পার্কের মতো করে।ওয়াটার বোটে পুরো শহরটাই মোটামুটি ঘোরা হয়ে যায়।ঝঙ্কার স্ট্রিট ও হিরেন স্ট্রিটকে আলাদা করেছেএই মালাক্কা নদীটি।





নৌ-ভ্রমণ শেষে ওয়াটার বোট থেকে নেমে বিচিত্র এক যানবাহন দেখি।দেখতে অনেকটা আমাদের রিক্সা বা অটো আকৃতির।যা কর্কশিটের তৈরি অনেক রকমের পুতুল বা পাখি দিয়ে সাজানো।গাড়ির উপরে থাকে প্রজাপতি আকৃতির একটি ছাতা।গাড়ীতে গান শোনার জন্য সাউন্ড বক্স লাগানো ছিল, তাতে কোনটায় বাজছে হিন্দি, কোনটায় মালয়,বা ইংরেজি।আরোহীর রুচি অনুসারে গান বাজে।পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় এই বিচিত্র যানবাহন।মূলত কাঠামোগত কারনে সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।আমরাও একটা ভাড়া নিলাম, হিন্দি রোমান্টিক গান শুনতে শুনতে ঝঙ্কার স্ট্রিটে পৌঁছে গেলাম।

ঝঙ্কার স্ট্রিটেই মূলত বেশী পর্যটকের আনাগোনা। এটি মালয়েশিয়ার অতি পুরনো ও ঐতিহাসিক এলাকা।কিছুটা উঁচু নীচু বাটিলা জাতীয় এই এলাকা।চারদিকে গাছ-গাছালি দিয়ে গোছানো।কিছু গাছ বেশ বয়স্ক,শিকড় বড় জায়গা নিয়ে বিস্তৃত।এলাকাজুড়ে থাকা প্রাচীন স্থাপনা গুলোই বলে দিচ্ছিল এই শহরের বয়স হয়েছে।রাস্তায় এখানে নজরে পড়ল ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরছে পুলিশ।প্রাচীন স্থাপনার সাথে অশ্বারোহী পুলিশ, বেশ মানিয়েছে বৈকি! এর আগে আমি চেন্নাই এর মেরিনা বীচে টুরিস্টপুলিশকে দেখেছি ঘোড়ার পিঠে চড়ে ডিউটি করতে।

প্রথমে গেলাম স্থাপত্য মিউজিয়ামে। জাহাজ, রেলগাড়ি, উড়োজাহাজসহ বিভিন্ন স্থাপত্য নকশার দেখা মেলে এ জাদুঘরে। এছাড়া পুরানো গাড়ী, ইন্জিন,পূর্বে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্র- পাতি
তারপর গেলাম সেন্ট পল চার্চ ও মালাক্কা ডাচ স্কয়ার।ফ্যাহমাসা ফোর্ট , খৃষ্টচার্চ, চেং হুং টেং টেম্পল যেখানে সংরক্ষণ করা আছে মালাক্কার সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও তথ্যচিত্র।ফোর্টে এক ইন্ডিয়ানের সাথে পরিচয়,মালাক্কায় রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সাথে জড়িত।ভারত থেকে বেড়াতে আসা বন্ধুদের নিয়ে এসেছেন।উনি বলল, সময় থাকলে ‘আফা মুসা পার্ক’এ যাওয়ার কথা।ওখানে বাঘের সাথে বন্ধুত্ব করা যায়।এই পার্কে থাকা বাঘ গুলোকে নাকি ছোট বেলা থেকে এমন ভাবে লালন-পালন করা হয়,যেন তারা মানুষকে বন্ধু মনে করে।আমি অবশ্য 2008/9সালের দিকে থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুড়িতে টাইগার্স টেম্পল গিয়েছিলাম।সেখানে অনেক গুলো বাঘের সাথে ছবি তোলা, আদর করার অভিজ্ঞতা হয়েছে।সময় থাকলে এখানেও যেতাম, কিন্তু সময় নেই।




এরপর গেলাম মালাক্কা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। ১১০ মিঃ উচু এই টাওয়ারটা ঘূর্ণায়মান।কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটা রুমের মতো।রুমটিতে প্রায় 60/65 জন বসার মতো সিট আছে।পর্যটকদের আকর্ষণের রাইড এটি, তাই টিকেট নিয়ে লম্বা লাইনে আসতে হল।অপারেটর গেট ও সিকিউরিটি নিশ্চিত করে যাত্রা শুরু করার পর যত উচুঁতে উঠতে থাকলো যাত্রীরা তত আনন্দ ও বিস্ময়ে চারিদিকে তাকিয়ে ছিল।বেশীর ভাগ মানুষ ছবি বা ভিডিও করায় ব্যস্ত হয়ে গেল।দিগন্তবিস্তৃত সাগরের নীলাভ জল,দূরে নীলজলে ভাসমান সাদা জাহাজকে অনেকটা রাজহাঁসে মতো লাগছিল।আবার অন্যদিকে ছিল মালাক্কার ঐতিহাসিক সব দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, পর্তুগিজ, ডাচ, জাপানি ও ব্রিটিশদের বিভিন্ন নিদর্শন।যা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নতুন প্রজন্মকে গল্প বলারজন্য।চূড়ায় গিয়ে বেশ ধীর লয়ে ঘুরে কিছুসময় ধরে।তারপর আবার নীচে নামতে শুরু করে। পুরো তিন’শ ষাট ডিগ্রি ‌অ্যাঙ্গেল থেকে মালাক্কা শহরকে দেখা যায়, এই টাওয়ার থেকে।ওঠা-নামায় সময় নেবে প্রায় দশ মিনিটের মত।মাত্র দশ মিনিটে পুরো মালাক্কাকে একবার দেখার এই আয়োজন মন্দ নয়,তবে আমার মনে হয়েছে উপরে থাকার সময়টা আরেকটু বেশী হলে ভালোহতো।যত সময় ধরে মানুষ লাইনে অপেক্ষা করে তার তিন ভাগের এক ভাগ সময় সে উপভোগ করে।

অনেক বড় বড় সিটিতেই থাকে এমন টাওয়ার থাকে, যাতে এক নজরে পুরো শহর দেখা যায়।কিন্তু আমাদের ঢাকায় নেই।সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশে এমন টাওয়ার তৈরি করা যায় কি না ভেবে দেখতে পারেন কর্তৃপক্ষ।





মালাক্কার শহরটি ছোট বলে পায়ে হাঁটা দূরত্বের মধ্যে ১০-১৫টি স্পট আছে,মূলত পর্যটকের একদিনে ট্যুর এসে এর বেশী দেখারসময়ও পায় না।এখানকার পর্যটক সাধারণত কুয়ালালামপুর থেকে ডে ট্যুর আসা মানুষ।সুলতানের বাড়ি, হেরিটেজ মিউজিয়াম, সেন্ট পল চার্চ, মালাক্কা ফেমোসা, মালাক্কা ডাচ স্কয়ার, মালাক্কা স্কাই টাওয়ার, স্থাপত্যমিউজিয়াম, মসজিদ ট্রানকুরাহ,ফ্যাহমাসা ফোর্ট , খৃষ্টচার্চ, চেং হুং টেং টেম্পল সব স্থাপনাই কাছাকাছিই বলা যায়।





অনেক হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত হয়ে আমরা একটা মার্কেটের ফুড কোটে গেলাম খেতে।আমরা জাহাজ থেকে কিছু ইউ এস ডলার রিংগিত করে এনেছিলাম। ভেবেছিলাম এতেই আমাদের ডে ট্যুর হয়ে যাবে।কিন্ত বিভিন্ন জায়গায় খরচ করে আমাদের কাছে আর রিংগিত ছিল না।কার্ডও সীপে রয়ে গেছে।ডলার ভাঙাতে চেষ্টা করলাম ঈদের কারনে মার্কেটের মানি এক্সেইন্জ গুলোও বন্ধ।তাই খাবার খাওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেলাম।একটা কেএফসি ঢুকে ডলারে পেমেন্ট করতে চাইলাম রাজি হল না।আমরা নিজেদের মধ্য বাংলায় কথা বলতে শুনে এক লোক এগিয়ে এসে আমাদেরকে তার রেস্টুরেন্টে খেতে অফার করলো।ভদ্র লোক বাংলাদেশী, সিলেটের।ওরা ডলারে পেমেন্ট নিয়ে বাকী রিংগিত ফেরত দিয়েছিল।এতে আমরা কিছু চকলেট এবং গিফট কিনতে পেরেছি।স্থানীয় খাবারের পাশাপাশি ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি ও বাঙালি সব ধরনের খাবার ছিল তার রেস্টুরেন্টে।এখানে স্থানীয় ফুডের পাশাপাশি ফাস্টফুড চেইন সপও অনেক।ততক্ষণে প্রায় বিকাল হয়ে গেছে।সময় দেখে আমরা জোর পায়ে হাঁটলাম পিক পয়েন্টের দিকে যেখানে গাইড আমাদের বাসে তুলবেন।

আমরা গিয়ে দেখি প্রায় সব যাত্রীরা আগেই চলে এসেছে।একটু পরই বাসও এসে গেল।মনে মনে ভাবলাম এরা বা ট্যুর গাইড তো বাঙালী নয় যে টাইম জ্ঞান থাকবে না।





ফেরা পথে আমাদের বাস 30 মিনিটের যাত্রা বিরতি দিয়েছিল সাগর পাড়ের একটা খোলা জায়গায় যেখানে ছোট বড় রেস্টুরেন্টসহ কেএফসি,ম্যাকডোনালের মত ফুড চেইন সপও ছিল।বাস থেকে নেমে যাত্রীরা যে যার মত গেল।কেউ ওয়াসরুমের খোঁজে, কেউ রেস্টুরেন্টে, কেউ শপিং করতে।আমি গেলাম সৈকতে পা ভিজাবো বলে।আমার পার্টনার আইসক্রিম নিয়ে এলে সাগরপাড়ের পাথরের বসে আইসক্রিম খেতে লাগলাম সাগরের মিষ্টি বাতাস আর ঢেউের গর্জন শুনতে শুনতে।একটু দূরেই বাচ্চারা খেলছিল।পড়ন্ত বিকেলে সমুদ্রপাড়ে বাচ্চাগুলোর নির্মল আনন্দ দেখে আমিও যেন নিজের শৈশবে হারিয়ে গেছি কিছু সময়ের জন্য।নগর জীবনের ব্যস্থতার ভিড়ে আমাদের দেশের শিশুদের শৈশব তো এখন বলতে গেলে বিবর্ণ।কেবল নিজেকে দেবার মতন কোন সময়ই তার নেই। সেই সকাল থেকে শুরু করে স্কুল বড় বড় বইয়ের বোঝা, পড়ার চাপ কোচিং গান/নাচ/ড্রয়িং শেখা, সবমিলে মহা ব্যস্ত সে। নিজেকে দেবার কোন সময় তার নেই। তাছাড়া ইন্টারনেট আর মুঠোফোন তো আছেই।





আইসক্রিম শেষ করে খোলার মাঠ পেরিয়ে এক মার্কেটে নীচে দেখলাম একটা টেবিল পেতে একজন লোক মনোযোগ দিয়ে পাথরের উপর চিকণ তুলিতে বিভিন্ন নকশা আঁকছিল।আমি কিনতে চাইলে সে ছোট এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিল, আঁকতে বা লিখতে।তাই সে পাথরে এঁকে দিবে।নিজেও আঁকতে পারে ইচ্ছে করলে, রং-তুলী রাখা ছিলো।আমি একটা পাথর নিয়ে মনের সুখে ব্যাঙের ঠ্যাং গোছের কিছু একটা এঁকে ফেললাম। নিজের শিল্পকর্ম দেখে নিজেই লজ্জা পেলাম।





শেষবারের মতো আমাদের বাস যাত্রা শুরু করলো বন্দরের উদ্দেশে,যেখান থেকে লঞ্চে করে আমরা জাহাজে ফিরবো।আমি জানালার কাঁচের বাহিরে তাকিয়ে পেছনে ধাবমান জনপদ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, কয়েক ঘণ্টার এমন ঝটিকা সফরে কখনো কোন শহর সম্পূর্ণ জানা যায় না,জানা যায় না তার ইতিহাস, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য।শুধু ধারণা করা যায় মাত্র। তারপরও যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে মালাক্কা মালয়েশিয়ার প্রাচীন ঐতিহ্যকে শুধু ধারণই করেনি, সংরক্ষণও করছে ভালবাসা ও সতর্কতার সাথে। তাই এখানকার ঘরবাড়ী,রাস্তাঘাট থেকে সব কিছুতেই রয়েছে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের চিহ্ন।





সময়ের ‍অভাবে পুরো শহরটি ঘুরে দেখতে না পারার অতৃপ্তিও থাকলেও কিছু সুন্দর স্মৃতি, আনন্দময় মুহূর্তের ছবি তো স্মৃতির খাতায় জমা হলো।এটাও কম কিসের! মনে মনে ভাবলাম,পরিক্ষায় পাশের জন্য মুখস্থ করা মালাক্কা প্রণালীকে যতই রসকষ বিহীন ও বিরক্তিকর মনে হোক না কেন, বাস্তবে মালাক্কা কিন্তু তা নয়।আর মনে মনে বললাম 'বিদায় ইতিহাসের খোলা বই'।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post