তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাই। বিশ্বের 31 তম বৃহত্তম মহানগর চেন্নাই,দক্ষিণ ভারতের রাজ্য তামিলনাড়ুর রাজধানী।যা আগে মাদ্রাজ নামে পরিচিত ছিল। দক্ষিণ ভারতের প্রবেশ পথ হিসেবে পরিচিত শহরটিকে প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শহরও বলা যায়।
এই কয়েকদিনে মনে হল,ভারতের চতুর্থ জনবহুল এই মহানগরী ব্যস্ত হলেও ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার উৎস স্থল।শাস্ত্রীয় নৃত্য ভারতনাট্যমের জন্য এ শহর বিখ্যাত।তবে সামাজিক জীবন যাপনে তারা বেশ রক্ষণশীল,বিশেষ করে নারীদের পোশাকে দেখে সহজে বোঝা যায়,যা ভারতের অন্য শহরের মতো নয়।আমার কাছে মনে হলো পোশাকে এরা বাংলাদেশী নারীদের মতোই রক্ষণশীল।তবে আমাদের চেয়ে বেশী পরিশ্রমী এবং কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতিও বাংলাদেশের নারীদের চেয়ে অনেক বেশী।
এশিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম সৈকত শহর চেন্নাইয়ে বাংলাদেশীরা সাধারণত বেড়াতে আসে না, আসে ডাঃ দেখাতে। বিশেষ করে চেন্নাই এ্যাপোলো এবং সংকর নেত্রালয়ে আসে।তবে ডাঃ দেখানোর শেষে সবাই কম বেশী বেড়ায় এবং শপিং করে।এটা শুধু বাংলাদেশী বললে ভুল হবে, বাংলা ভাষী বলা উচিৎ।আমি বিভিন্ন জায়গায় অনেক কতজন মানুষের সাথে কথা হয়েছে। সবার একই উদ্দেশে এখানে আসা। যদিও আমরা ব্যতিক্রম।আমরা চেন্নাই গিয়েছিলাম তামিলনাড়ুর হিল শহর উটি, কুন্নূর যাওয়ার ট্রানজিট হিসেবে।আর যাওয়া আসার সময় এই প্রাচীন শহর যেটুকু সম্ভব হয়েছে দেখেছি।
পূর্ব পরিকল্পনায় চেন্নাইয়ে কিছু ব্যক্তিগত কাজ,বাদ্যযন্ত্র কেনা, ঔষধ কেনা ছিল।কিন্তু টিকেট জটিলতায় দুই / তিন দিন বেশী থাকতে হওয়ায় চেন্নাই সিটি ট্যুরের সিদ্ধান্ত নিলাম।উটি যাওয়া আগে ট্র্যাভেল এজেন্টের সাথে আলাপ করে জেনেছি ওরা সিটি ট্যুরের প্যাকেজ করে,12 পয়েন্ট দেখাবে এন্ট্রি টিকেট, যাতায়াত সহ 430 রুপি। সকাল 9টায় পিক করবে, ড্রপ রাত 8/8.30।সুলভ প্যাকেজ বলতে হবে।কিন্তু আমার পার্টনার নন এসি লোকাল বাসের এই প্যাকেজে যেতে রাজী হয়নি, তাই আমরা 12 পয়েন্টের বদলে 5/6টা জায়গা নিজেদের মতো করে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
উটি থেকে ফেরার পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে অটো নিয়ে আমরা চলে এলাম বিবেকানন্দ হাউসে।কারন এটি খোলা থাকে নিদিষ্ট সময়, যা আমাদের হোটেলের ইনফরমেশন ডেক্সের মেয়েটা জানালো।১৮২২ সালে ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই স্থাপনার প্রাক্তন নাম আইস হাউস।পরবর্তীতে মাদ্রাজ হাইকোর্টের একজন আইনজীবি বিলিজি আয়েঙ্গার ক্রয় করেন, যিনি এটি কাসল কেরন নামে নামকরণ করেন। 1897 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটেন ও আমেরিকা সফর থেকে ফিরে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব স্বামী বিবেকানন্দ চেন্নাই এসেছিলেন।তখন তিনি এখানে থেকেছেন।1902 সালে তিনি চলে গেলেও তাঁর নামে উৎসর্গীকৃত আশ্রমটি এখনও বিবেকানন্দ হাউস নামে রয়ে গেছে। রামকৃষ্ণ মঠ দ্বারা এটি পরিচালিত হয়।এখানে স্বামীজির জীবন এবং ভারতীয় সংস্কৃতির উপর একটি স্থায়ী প্রদর্শনী ঘর রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় একটি মেডিটেশন রুম রয়েছে। হলটিতে সাপ্তাহিক ধ্যান ক্লাস হয়।কেউ ধ্যান সেশনে যোগদান না দিলেও, বিল্ডিংটি দেখার মতো। চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। এটি সকাল 10.00 টা থেকে 1২.30 টা এবং 3.00 টা থেকে 7.15 টা পর্যন্ত খোলা থাকে, প্রতিদিন সোমবার ছাড়া। টিকিট প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২0 টাকা এবং শিশুদেরজন্য 10 টাকা।
বিবেকানন্দ হাউস থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম জাদুঘরে।কোন দেশ বা শহরের সিটি ট্যুরে আমার বরাবরই জাদুঘরে আগ্রহ।কারন এতে একটি দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য জানা যায়।চেন্নাই জাদুঘর ভারতের প্রাচীনতম জাদুঘর গুলোর একটা।কিন্তু আমাকে চরমভাবে হতাশ করেছে এই জাদুঘর। এখানে তেমন কোন আকর্ষণীয় বা প্রাচীন সংগ্রহ নেই।সংগ্রহ খুবই দুর্বল, পর্যটকআকর্ষণ করার মতো কিছু নেই। আছে কিছু প্রাচীন মুদ্রা, ব্রোঞ্জ বা কাঠ বা পিতলের তৈরি অস্ত্র, বর্ম।এখানে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক চরিত্রের চিত্র প্রদর্শনীতে হয়।এছাড়া কিছু প্রাণীর ফসিল, গাছপালা আছে।
জাদুঘর থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম 1653 সালে নির্মিত ফোর্ট সেন্ট জর্জ এ।যা এখন তামিলনাড়ু আইনসভা।গ্র্যান্ড সেন্ট মেরি চার্চকেও এর মধ্য অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে এখন।এটি ব্রিটিশদের দ্বারা নির্মিত সবচেয়ে পুরনো গীর্জাগুলির একটি।এটি ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
সেন্ট মেরি চার্চ থেকে বের হতেই স্টোমাক কড়া নির্দেশ দিলো আর ঘুরাঘুরি না, এবার খেতে হবে।তাই আমরা আমাদের রামাদা হোটেলের পথে রওনা দিলাম, আজকের মতো বেড়ানো শেষ দিয়ে। এছাড়া বিকালে আমাদের অন্যও কাজ ছিল পরিকল্পনা অনুসারে, সেই তাড়াও ছিল।রাস্তায় অনেক হোটেল ছিল। কিন্তু আমরা রামাদায় সুইমিংপুল পাড়ে বসে খেতে পছন্দ করি পরিবেশগত কারনে।আমি খাঁটি বাঙ্গালী হলেও আমার পছন্দ ভারতীয় কুজিন। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয় খারাব ইডলি,মম,মটর পনির তো আমার সবচেয়ে বেশী পছন্দ।বাংলাদেশীদের মুখে প্রায় শোনা যায় পশ্চিম বাংলা ছাড়া কোথাও খেতে পারে না। আমি অবশ্য বলবো পশ্চিম বাংলার খাবার তো ইন্ডিয়ান কুজিনেই পড়ে না।
পরের দিন সকালবেলা ব্যক্তিগত ব্যস্ততা ছিল, তাই দুপরের পর বের হলাম কপালেশ্বর মন্দির দর্শনে।কপালেশ্বর মন্দির সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য দেবতা শিবের মন্দির। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর আশেপাশে দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি মন্দিরটি চেন্নাই এর পর্যটকদের প্রধান একটি আকর্ষণ।শুধু পর্যটক নয়, ধর্মীয় দিক থেকেও এই প্রাচীন মন্দিরটি তীর্থযাত্রীদের কাছে পবিত্র।মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার পর পর্তুগিজদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে বিজয়নাগরা সাম্রাজ্য কর্তৃক তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। তাই মন্দিরটির পুরাকীর্তি দ্রাবিড় যুগ ও বিজয়নাগরা সাম্রাজ্যের সমন্বয়ে তৈরি।মন্দিরটি শহরের প্রাচীনতম অংশে অবস্থিত।এটি ভারতের ব্যস্ততম মন্দিরগুলোর একটি।
এই মন্দিরে শিবের সঙ্গী পার্বতীর যে রূপকে পূজা করা হয়েছিল তাকে করপগাম্বল বলা হয় তামিল ভাষায় এবং শিবকে কপালেশ্বরর হিসাবে পূজা করা হয়।পুরাণ অনুসারে, শক্তি ময়ূরের আকারে শিবের উপাসনা করেছিলেন।মন্দিরের আশেপাশের এলাকাকে মাইলিলি নাম দেওয়া হয়েছিল, ময়ূরকে তামিল ভাষায় মাইলিলি বলা হয়।
এই সাংস্কৃতিক বিস্ময়টিকে ঘিরে অনেক লোককথা প্রচলিত আছে।কথিত আছে, কপালেশ্বর মন্দিরটি এমন এক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে শিব তাঁর ভক্তির পরীক্ষা হিসাবে তাঁর স্ত্রীকে ময়ূরে পরিণত করেছিলেন। পার্বতী শিবের ধ্যান করেএবং তাঁর মূল রূপে ফিরে এসেছিলেন।
প্রচলিত বিশ্বাস,যে মন্দিরের শিব লিঙ্গম সুয়ম্বুলিংম যার অর্থ এটি আত্মপ্রকাশিত। চারটি বেদ এই শুভ স্থানে শিবের উপাসনা করেছেন বলে বেদপুরী নামেও পরিচিত। ধর্মীয় স্থানটির অন্য নাম দেওয়া হয়েছে সুকরাপুরি, কারণ সুকরাচার্য তাঁর চোখ ফিরে পেতে এই জায়গায় শিবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে ভগবান শিবের কাছ থেকে তাঁর সৃষ্টির শক্তি ফিরে পেতে ভগবান ব্রহ্মা এখানে তপস্যা করেছিলেন।
কপালেশ্বর মন্দিরের ভিতরে অনেক গুলো আলাদা আলাদা মন্দির রয়েছে।এছাড়া মন্দিরের জাঁকজমকের সাথে যোগ করা হ'ল ভগবান গণেশের প্রতিমা নর্দান বিণায়ক বা নৃত্যরত বিনায়াক এবং ভগবান মুরুগ যিনি সিঙ্গারভেলনের ভূমিকায় উপস্থিত হন।
মন্দির চত্বরে পবিত্র পুন্নাই গাছ রয়েছে যা চেন্নাইয়ের প্রাচীনতম গাছগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করা হয় গাছটির অবস্থান মন্দিরের পরিবেশকে স্নিগ্ধ রূপ দান করেছে। তবে মূল ফটক আর প্রতিটি ভবনের চূড়ায় কারুকাজ আমার বেশী ভালো লেগেছে।
মন্দিরের প্রবেশের সময় সকাল থেকে 5 টা দুপুর 12টা পর্যন্ত, তারপর 4.30 থেকে রাত 9.30 পর্যন্ত।মন্দিরে কোন প্রবেশ ফী নেই।তবে এই মন্দিরে মার্চ বা এপ্রিলে বার্ষিক পূজা হয়, যা 'পাঙ্গুনি পেরুভিজা' উৎসব নামে পরিচিত।তখন মন্দিরের প্রতিমাগুলিকে চমৎকার করে সাজিয়ে কাঠের রথের উপর বসিয়ে রাস্তায় প্যারেড করা হয়।তখন তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের অনেক ভীড় হয় শহর জুড়ে।
কপালেশ্বর মন্দিরের কাছেই বেশ কিছু মন্দির ও গীর্জা ছিলো। তার মধ্যে সেন্ট থমাস বেসিলিকা, জৈন মন্দির, তিরুভল্লুভর কোয়েল অন্যতম।আমার অবশ্য এগুলোর কোনটাই দেখা হয়নি।আমি তো মুগ্ধ চোখে দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্য শৈলীর অনবদ্য নিদর্শন কপালেশ্বর মন্দিরই দেখতে দেখতে সব সময় পার করে ফেলেছি।
আমি কপালেশ্বর মন্দির থেকে বেরিয়ে মেরিনা বিচের দিকে গিয়েছিলাম। এই সৈকত কাছেই ছিল।চেন্নাই শহরে এসে কেউ মেরিনা বিচে যাবে না, এমন বেরসিক মানুষ মিলবে না বোধ হয়।
মেরিনা বিচ ভারতের বৃহত্তম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ সমুদ্র সৈকত। চেন্নাই শহরের মৈলাপুরে এই বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত। এই দীর্ঘতম শহুরে সমুদ্র সৈকত, ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাছাকাছি থেকে শুরু করে 13 কিলোমিটার দক্ষিণ পর্যন্ত।
চেন্নাই শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও আছে এই সৈকত ঘেষা মেরিনা বিচ ড্রাইভ রোড ঘেঁষে।মেরিনা বিচ রোডে মহাত্মা গান্ধীও দ্যা ভিক্টরি অব লেবার নামের দুটো বিখ্যাত ভাস্কর্য ছিলো।বীচ সংলগ্ন সড়কের পাশে মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্যটি ভারতীয় রাজনীতির শান্তি সাম্য নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।'দ্যা ভিক্টরি অব লেবার' মূলত অসংখ্য মূর্তি নিয়ে তৈরি।এটি স্থানীয়দের কাছে খুবই জনপ্রিয়।যা মানুষের ভীড় দেখে অনুমান করা যায়।আমরা যখন সৈকতে এসেছি তখন সূর্য মামার তেজ মাত্র পড়লো বলে।রবিবার ছিলো বলে মানুষের ভীড় অনেক।এতো মানুষের ভীড় আমার পছন্দ নয় সৈকতে। সৈকত হবে নিরিবিলি,বাতাস আর সাগরের গর্জনই যেখানে প্রকৃতির নীরবতার ধ্যান ভাঙাবে।তেমন পরিবেশ না হলে সৈকত এসে মানুষ ঢেউয়ের সুরে মন ভিজাবে কিভাবে।আমার ভারতীয় সৈকতের অভিজ্ঞতা ছিল না। এখানে এসে বাস্তব ভারতীয় সৈকতের অভিজ্ঞতা হল।আমার কাছে অনেকটা বাংলাদেশের সৈকতগুলোর মতোই লেগেছে। জনাকীর্ণ পরিবেশ আর সাগরের পানিও রং দুটোই আমাদের কক্সবাজারের মতো।
আমরা কিছুদূর হেঁটে যেতেই কয়েকজন ঘোড়া উঠানোর জন্য পিছু নেয়, বারবার বলা শর্তেও পিছু না ছাড়ায় শেষে ঘোড়া ভাড়া নিলাম আমরা দুটো।ঘোড়া যখন সাগরের পানি দিয়ে হাঁটছে, তখন সহিস রশি ছেড়ে দিচ্ছিল বারবার।এতে আমি ভীষণ ভয়ে ছিলাম, প্রথম বার বলে কথা।তবে অভিজ্ঞতা মন্দ নয়।
ঘোড়া বিদায় দেয়ার পর হাঁটতে শুরু করলে এক ফুলওয়ালী ধরলো চুলে ফুলের মালা লাগাবে। আমি তাকে মজা করে দেখালাম আমার চুল ছোট ফুল লাগানো যাবে না,তাই নিবো না। সেও মজা পেল,আমার ছোট চুলে ক্লীপ দিয়ে ফুল লাগিয়েই ছাড়লো সে।ফুল লাগানোর পর আমার নিজেকে ফানি ওমেন এর মতো লাগছিল।বিশ্বের অনেক দেশ থেকে পর্যটক আসে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম বালুকাময় এই উপকূলে সূর্যস্নানে।তবে এখানে পানিতে স্নান এবং সাঁতারের অনুমতি নেই।
সূর্যোদয় আর সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দুটোই দেখতে পর্যটকরা এই সৈকতে আসলেও, সূর্যাস্ত দেখতে আসা মানুষের সংখ্যাই বেশী।আমরা বেশ দূর হেঁটে গেলাম ভীড় এড়ানোর জন্য।এক জায়গায় সৈকতের একপাশে অনেক গুলো নৌকা ছিলো, কিছু নৌকা বালির উপরেও ছিল। একটা নৌকার কার্নিশে বসে অস্তমান সূর্যের অতুলনীয় সৌন্দর্যকে বিস্ময় বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম এই শহরের মানুষেরা আমাদের চেয়ে সৌভাগ্যবান। তারা চাইলেই দশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে শহরের যে কোনস্থান থেকে সৈকতে এসে সূর্যাস্তের আবির রঙে নিজের মন রাঙাতে পারে। সৈকতের দক্ষিণ প্রান্তে ছিলো বাতিঘর।সূর্যাস্তের সৌন্দর্যে গভীর ভালো লাগার আবেশে আবিষ্ট হয়ে ,অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে সাগরের ঢেউয়ে নেমে পা ভেজাতে ভেজাতে ফেরার পথ ধরলাম।
স্থানীয়রা মেরিনা বিচে সন্ধ্যায় ভিড় জমায়, কেউ ঘুড়ি উড়ায়,কেউ প্যাডেলিং করে, কেউ আবার এমনি বালির উপরে বসে বাতাস উপভোগ করে।পিকনিকের জন্যও সেখানে ছুটির দিনে স্থানীয় পরিবার আসে।
ফেরার পথে তোতা নিয়ে বসে থাকা এক লোককে ঘিরে থাকা ঝটলা দেখে বুঝলাম এখানেও কার্ড বাছাই করে ভবিষ্যদ্বাণী বলা 'তোতা জ্যোতিষীর' আছে।আধুনিক যুগেও এদের ব্যবসা চলছে দেখা অবাক লাগে।
মেরিনা বিচে আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় বিষয় ছিলো ঘোড়া আরোহী টুরিস্ট পুলিশ।তেজী দুটো ঘোড়া নিয়ে খাকি পোশাক আর মাথায় হেট পরা দুই টুরিস্ট পুলিশ ব্রিটিশ শাসনের সময়ে নিয়ে গেছে কয়েক মিনিটের জন্য। টুরিস্ট পুলিশের এমন রাজকীয়ভাব বেশ লেগেছে আমার।
মেরিনা বিচ থেকে ওয়াক দূরত্বে ফোর্ট সেন্ট জর্জ, ফোর্টের অদূরে সেন্ট মেরি চার্চ, ফোর্টের উত্তরে আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে আর্মেনিয়ান সিমেট্রি।কিন্তু আমরা বিচে থেকে বেরিয়ে আসতে 8/8.30 বেজে গিয়েছিল, তাই আর কোথাও যাওয়া সময় ছিল না।বিচ সংলগ্ন রোডের দুপাশে অনেক স্থানীয় মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছিল,স্ট্রিট ফুডে দোকানগুলোও আড্ডাকে দীর্ঘতর করতে সহযোগিতা করছিল।ভালোই, নগর জীবনের ক্লান্তিকর ব্যস্ততা থেকে মুক্তির জন্য এমন আড্ডার স্থল জরুরী। যা থেকে আমরা ঢাকাবাসী বঞ্চিত।আমাদেরকে বিনোদনের জন্য যেতে হয় শপিং মলে বা রেস্টুরেন্টে।আমারও এখানে বসে সাগরের মাতাল বাতাসে মন ঘুড়ি উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু পরদিন দেশে ফেরার ফ্লাইট, তাই মনের ইচ্ছে অবদমন করে হোটেলের পথ ধরতে হলো।
হোটেলে ঢুকে নজর পড়লো অতিথিদের অবয়ব আঁকা শিল্পীর অতিথির চেয়ার খালি, তাই বসে পড়লাম।আমারও আজ এই হোটেলে শেষ রাত, স্মরণীয় করে রাখতে ইচ্ছে হল।ডিজিটাল যুগে শিল্পীকে দিয়ে অবয়ব আঁকানো অনেকের কাছেই অর্থহীন হলেও আমার কাছে এটা একটা শিল্পীকর্ম।বিনোদন স্পটে এমন শিল্পকর্ম আনন্দদায়কও বটে।বেশ সময় নিয়ে শিল্পী আমার চশমা ছাড়া অবয়ব যখন আঁকা শেষ করলে, আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম।জানি না শিল্পীর আঁকতে কত কষ্ট হয়েছে, তবে আমার মডেল হতে অনেক কষ্ট হয়েছে।কারন অনেক ক্ষণ একইভাবে বসে থাকতে হয়েছিল।তবে নিজের চশমাহীন ছবিটা অবাক হয়ে দেখেছি, কখনো চশমা ছাড়া ছবি তুলেছি বলে মনে পড়ে না।
রুফটপ রেস্টুরেন্টে লাইভ মিউজিক শুনতে শুনতে ভাবছিলাম,এই শহরে থাকার সময় দুই দিনের বদলে যখন ছয়দিন হয়ে গেল টিকেট জটিলতায়, তখন মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছিলাম সময় কাটাবো কিভাবে ভেবে।কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সময় বেড়ে ভালোই হল, না হলে শহরটা অদেখাই থেকে যেত।ডিনারের শেষে ওয়েটার এসে আর কিছু লাগবে কি না জানতে চাইলে, তাকে একটা গানের কলি টিসুতে লিখে দিলাম,গায়ককে গাইতে দেয়ার জন্য।কেন জানি এখানে গায়ক কারো রিকুয়েস্ট ছাড়া হিন্দি গায়না, ইংলিশ গান গায়।এরা তামিলভাষা বা ইংরাজি বলে হিন্দি বলে না, তবে হিন্দি জানে,বলে না ইচ্ছে করে আমার মনে হয়।গায়ক যখন আমার আমার পছন্দের গান গাইতে শুরু করলো-
'Nothing's gonna change my love for you
You oughta know by now how much I love you... আমিও গুনগুন করে গলা মিলালাম।এই শহরে লাষ্ট ডিনার বলে কথা☺️
0 মন্তব্যসমূহ