সার্ফার (কুটা,বালি, ইন্দোনেশিয়া )
ককপিট থেকে এনাউন্স হলো সিট বেল্ট বাঁধার,বিমানের ভিতর খুঁটখাঁট আওয়াজ শুরু হল।সবার মতো আমিও নড়েচড়েএটেনশন মুডে বসলাম।মনের মধ্যে চলছে দারুণ উত্তেজনা,দেবতার দ্বীপ দেখার।বারবার জানালায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি, ভাবখানা এমন যেন বিমানের জানালা দিয়েই মেঘের ফাঁকে দেবতার পবিত্র সৌম্য মূর্তি এই বুঝি দেখা যাবে।☺️দেবতার প্রতিকৃতি না দেখা গেলেও, ল্যন্ডিং এর সময় বিমান ঝাঁকিয়ে প্রকৃতির চরম সৌন্দর্য দেখার যেন আহবান জানালো আমাদের।
নাগুরাহ রাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ত এয়ারপোর্ট।স্বাভাবিক কারনে ভীড় হবে।তার উপরবাংলাদেশীদের জন্য পোর্ট এন্ট্রি ভিসা, তাই ভেবেছিলাম ইমিগ্রেশনে লম্বা লাইন হবে।কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল খুব আধুনিক বাখুব বড় কোন এয়ারপোর্ট না হলেও তারা দক্ষ কর্মী এবং সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা দিয়ে চমৎকার টুরিস্ট সেবা দিচ্ছে।বালির এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমাদের কর্মকর্তাদের শেখার আছে, শেখার আছে অতি আধুনিক এয়ারপোর্ট ছাড়াও টুরিস্ট সেবা দেয়াযায়।
ইমিগ্রেশন, কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ট্র্যাভেলার সিম নিলাম।কোনো ব্যালেন্স ছাড়া সিমের দাম ১০,০০০ রুপিয়া।মিনিটআর জিবির জন্য আলাদা দাম।পরে অবশ্য টের পেলাম বাহিরে সিমের দাম আরো কম।এরপর এয়ারপোর্টের বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটি বালিনিজ মেয়ে ফুলের মালা দিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে স্বাগতম জানালো। তাদের অভ্যর্থনার ধরন আমার কাছে বেশ লাগলো।আমরা বুকিং ডট কমের মাধ্যমে রিসোর্ট বুক করেছিলাম কুটা এরিয়ায়।এয়ারপোর্ট থেকে পিক ড্রপ ভাড়ার সাথে কথা বলে নিয়েছিলাম। তাই আমাদের পিক করতে এসেছে রিসোর্ট থেকে।অনেক এয়ারপোর্টে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় ট্যাক্সি সার্ভিস থাকে, আবার কোন কোন এয়ারপোর্টে থাকে না।তখন পর্যটকেরা প্রতারিত হয় ভাড়া নিয়ে, নিরাপত্তার সমস্যা তো আছেই। তাই আমরা নতুন দেশে গেলে পিক ড্রপ হোটেলের সাথে রাখার চেষ্টা করি।
নাগুরাহ রাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম কর্নেল গুস্টি গুরা রায় নামক একজন জাতীয় বীরের নামে নামকরণ করাহয়েছে।নাগুরাহ রাইয়ের বীরত্ব নিয়ে আমি একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম।তাঁর ছবি 50000 ইন্দোনেশীয় রুপির নোটেও আছে।এজন্য প্রথম এখানে এসেও নামটা বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে।এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার কয়েক মিনিট পর মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন উপবিষ্ট রাজকীয় রথের বিখ্যাত দৃশ্যপটে আমার চোখ আটকে গেল।ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম কান্ট্রি সেখানে সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাসের পটভূমি নিয়ে নির্মিত কোন ভাস্কর্য থাকতে পারে ধারনা ছিল না, যদিও আমি সৌদি আরবের বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজের বালি সফরের সময় তাঁর সম্মানের রাস্তার পাশের মূর্তি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মানে নাই বালির প্রাদেশিক সরকার। এমন একটা নিউজ পড়েছিলাম।আমি ভেবেছি রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনকারী মূর্তি নিয়ে এই নির্দেশ।কিন্তু বালির রাস্তায় সাধারণ ভাস্কর্য পাশাপাশি ধর্মীয় ভাস্কর্য চোখে পড়ার মতো। এখানে এসে বুঝলাম ইন্দোনেশিয়ার সরকার ও জনগণের বৃহদাংশ সবসময় দেশটির সনাতন ধর্মীয় অতীতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এর অন্যতম প্রমাণ হল হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর বাহন গরুড় পক্ষীর নামানুসারে ইন্দোনেশিয়ার এয়ারলাইন্সের নামকরণ ‘গারোরা’ করা হয়েছে, আমার জানা মতে।তারা জানে অতীত ইতিহাস একটা জাতিকে সমৃদ্ধ করে,তাই এটা ধারন করা উচিৎ।আমি অবশ্য আমাদের দেশীয় সেই সব আন্দোলনকারীদের কথা ভাবছি,যারা অকারণে ধর্মের মতো পবিত্র বিষয়কে সৌন্দর্য বর্ধনকারী ভাস্কর্যের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে।তারা জানে না পর্যটন শিল্পের বিকাশ বাড়াতে হলে শুধু দামী কয়েকটা রিসোর্ট বা হোটেল তৈরি করলে হবে না,ঐতিহ্য, ইতিহাস সংরক্ষণ বা ধারনও করতে হয়।সাথে আরো অনেক কিছুও দরকার।
চেক ইনের আনুষঙ্গিকতা শেষ করে রুমে যেতে দুপুর গড়িয়ে গেল। স্টোমাকের বিদ্রোহ সময় মনে করিয়ে দিল।ফ্রেস হয়ে রিসোর্টের রেস্টুরেন্টেই খেয়ে নিলাম।এরপর বের হলাম ট্রাভেল এজেন্টের খোঁজে।আমরা দেশ থেকে প্যাকেজ হয়ে আসি না কোথাও।সেখানে গিয়ে 4/5টা এজেন্টের সাথে দরদাম করে সিদ্ধান্ত নি।আমাদের রিসোর্টটা কুটা বিচ সংলগ্ন, তাই এখানে ট্রাভেল এজেন্টের অভাবছিল না।কয়েকটা বড় বড় এজেন্টের সাথে কথা বলে তাদের ক্যাটালগ নিয়ে রুমে চলে এলাম দুজনে বসে সিদ্ধান্ত নিতে।
প্রথম বিকাল কুটা বিচে কাটানোর জন্য চলে এলাম সূর্যাস্তের আগে।নীল পানি আর সাদা বালির এই সৈকত পর্যটকদের পছন্দ জায়গা।আমাদের রিসোর্ট থেকে বিচ 2 মিনিটের হাঁটা পথ।বিচে সার্ফিং বোর্ড ভাড়া দেয়ার জন্য বালিতে গেঁথে সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো।আগেই জানি কুটা সার্ফিং এর জন্য বিখ্যাত।এখানে পৃথিবী বিভিন্ন দেশের সার্ফাররা আসে, আবার কেউ কেউ শিখতেও আসে, এখানে ট্রেনারও পাওয়া যায়।পর্যটক আর সার্ফারে সরগরম বলে খানিকটা হেঁটে নিরিবিলি পরিবেশে সরে গেলাম,সৈকতের নির্জনতা বেশী টানে বলে।কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশটা আবির রঙ থেকে লাল হয়ে উঠলো।নীল পানিতে লাল আকাশের প্রতিচ্ছায়া অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।ধীরেধীরে সাগরের বুকে হারিয়ে গেল আস্ত সূর্যটা।সূর্যাস্তের পর গাঢ নীল আলোয় খালি পায়ে ছোট ছোট ঢেউের সাথে তাল মিলিয়ে আরো কিছুসময় হাঁটলাম আমরা।
সৈকত থেকে বেরিয়ে এসে গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটলাম আশপাশ দেখার জন্য।বালির অন্যতম জাঁকজমকপূর্ণ এলাকা কুটা।শপিংমল, বার, মেসেজ পার্লার, রেস্টুরেন্ট সব মিলিয়ে জমজমাট এলাকা।হাঁটতে বেশ কিছু মানি এক্সচেঞ্জে ডলারের রেট দেখলাম আমরা।বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জে রেটের অনেক পার্থক্য।তবে অথরাইজড মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ভাঙ্গানো উচিৎ সবসময়।রেট কম পেলেও জাল টাকা বা বান্ডিলে টাকা কম হওয়ার ঝুঁকি থাকে না।আমরা কিছু রুপিয়া দেশ থেকে নিয়েছিলাম যাতে এয়ারপোর্টে ডলার ভাঙাতে না হয়।সেখানে রেট সবচেয়ে কম।আমরা যে কোন নতুন দেশে গেলে কিছু সেই দেশীয় কিছু টাকাসাথে নিয়ে যাই, যাতে সাময়িক প্রয়োজন মিটানো যায়।
অথরাইজ একটা মানি এক্সচেঞ্জে আমরা ডলার এক্সচেঞ্জ করলাম।প্রতি ডলারের বিনিময়ে আমরা 12 হাজার রুপিয়ার মতো পেয়েছিলাম। ইন্দোনেশিয়ায় সর্বোচ্চ ১ লাখ রুপিয়ার নোট পাওয়া যায়।আমি জীবনে প্রথম লাখ টাকার নোট দেখলাম।যে কয়দিন বালিতে ছিলাম সে কয়দিন নিজেকে বেশ রীচ রীচ মনে হলো।😂কারন লাখ লাখ টাকার কেনাকাটা করেছিলাম,হাজারে কোন কথাই নাই।
মানি এক্সচেঞ্জ থেকে বেরিয়ে আমি গেলাম ট্র্যাভেল এজেন্সিতে ট্রিপ বুক করার জন্য আর আমার পার্টনার গেল রেস্টুরেন্টের খোঁজে।দুই দিনের ট্রিপ বুক দিলাম সেবার মান যাচাই করে পরে বাকী দিনের দিবো শর্তে।ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে রুমেরপথ ধরলাম।এখানে ইন্ডিয়ান ফুডের দাম ব্যাংককের চেয়ে বেশি।যারা বাজেট ট্র্যাভেল করেন তারা স্থানীয় ফুড বা স্টিট ফুড ট্রাইকরা ভালো।খরব কম হবে।
সকালের ব্রেকফাস্ট শেষ করতে না করতে আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড বরুণ ফোন করে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করলো।নীচেএলে বরুণ উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিচয় পর্ব সেরে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। পরনে ছিল লুঙ্গি বা সারং আরফতুয়া, মাথায় বালির বিশেষ টুপি। তার পরনের ঐতিহ্যবাহী পোষাক আমাদের বালি ভ্রমণের শুভ সূচনাকে নতুন মাত্রা দিল।
আমাদের প্রথম গন্তব্য তামান আয়ুন বা রয়েল টেম্পল।বালির পর্যটনের মূল আকর্ষণ হলো হাজার, হাজার বছরের পুরনো হিন্দুমন্দির।আমি বালিতে আসার আগে পড়তে গিয়ে খেয়াল করেছি অধিকাংশ বাংলাদেশীরা তানার লট আর উলুয়াটু মন্দিরভিজিট করে।কিন্তু ছবিতে এই মন্দিরের রাজসিক স্থাপত্যশৈলী আমাকে মুগ্ধ করেছে।তাই ভাবলাম মন্দির দিয়েই আমাদের বালির ডায়রি ওপেন করি।প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো সময় লাগল গাড়ীতে।
প্রবেশ পথে দুজন কর্মী দাঁড়িয়ে দুই টুকরো কাপড় ধরিয়ে দিচ্ছে আমাদের সামনের সারির দর্শনার্থীদের।কিন্তু আমাদের দুই জনকেদিলো না।আমি কিছুটা হতাশ গলায় বরুণের কাছে জানতে চাইলাম কারন।সে জানালো এই মন্দিরের নিদিষ্ট ড্রেস কোড় আছে।কোন দর্শনার্থী হাঁটু খোলা বা কাঁধ খোলা পোশাক পরে মন্দির দর্শন করতে পারবে না।তাই যাদের পোশাক ড্রেস কোডের বাহিরে তাদেরকে এই কাপড় বা সারং,স্কার্ফ বা স্যাশ দেয়া হচ্ছে।আমরা যেহেতু খোলামেলা পোশাক পরিনি তাই আমাদের দেয়া হয়নি।
মন্দিরে ঢুকে মনে হল মন্দিরটির নামই শুধু রয়েল টেম্পল নয়,স্থাপত্যশিল্পেও রাজকীয় এবং আমার পছন্দ যথার্থ ছিলো।গাইড জানালো রাজা জোকারদা শক্তি ব্লাম্বাঙ্গনের আমলে তামান আয়ুন মন্দিরটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল 1632 সালে এবং 1634 সালে শেষ হয়েছিল। তামান আয়ুনের শব্দের অর্থ "সুন্দর বাগান"জটিল স্থাপত্যশৈলীর মন্দিরটি মেংউই সাম্রাজ্যের একটি পারিবারিক মন্দির হিসাবে নির্মিত হয়েছিল।তখন এটি কেবল রাজপরিবারের সদস্যরাই এখানে প্রার্থনা করতো। 25000 স্কয়ারমিটার এলাকা বিস্তৃত মন্দিরটির চারটি অংশ।তারমধ্যে "জেলুং" নামের জটিল অলঙ্কৃত কেন্দ্রীয় গেট শুধুমাত্র বিশেষ আনুষ্ঠানের সময় খোলা থাকে, যেমন পবিত্র উত্তরাধিকার এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিক জিনিসপত্রের প্রবেশ পথ।দর্শনার্থীরা দ্বিতীয় গেট দিয়ে যাতায়াত করে। জনশ্রুতি আছে মন্দিরটির তিনটি ভিত্তি,তিনটি মহাজাগতিক স্তরকে নির্দেশ করে,যেমন- মানুষের জগত, দেব -দেবতার রাজ্য এবং মহাজাগতিক স্তর।পর্যটন ছাড়াও মন্দিরটির ধর্মীয় গুরুত্ব অনেক স্থানীয়দের কাছে।বালিনিজ ঐতিহ্যবাহী ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতি 210 দিন পর প্রথম মঙ্গলবার স্থানীয় পূর্ণ্যার্থিরা মন্দিরে পূজা করতে আসে।এই বার্ষিকী অনুষ্ঠানকে 'পিওডালান' বলে।এছাড়া 2012 সালে ইউনেস্কো বিশ্ব সাংস্কৃতিক পর্যটন সাইটের অংশ হিসাবে তামানআয়ুন মন্দিরকে পুরস্কৃত করে।
মন্দিরের কারুশিল্পে এতটাই বিমোহিত ছিলাম কখন যে দুপুর হয়ে গেল টেরই পাই নাই।এমনকি গাড়ীতে উঠেও আমি দারুণ উত্তেজনা নিয়ে ক্যামেরার ছবিগুলো দেখিলাম।এখান থেকে বের গাইডকে বললাম ভালো রেস্টুরেন্ট দেখে লাঞ্চ ব্রেক দিতে।তখনসে জানালো
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পুরা উলুন দানু বেরাতান টেম্পল। গাইডকে ভালো রেস্টুরেন্ট দেখে লাঞ্চ ব্রেক দিতে বললে, সে জানালোমন্দিরের ভেতর রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা গাড়ী থেকে নেমে দেখি কুয়াশার মতো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, সাথে বাতাস।আমাদের কিছুটা অপ্রস্তুত চেহারা দেখে গাইড জানালো এই আবহাওয়া এখানে বেশ সাধারণ দৃশ্য।সে আমাদের হাতে টিকেট দিয়ে রেস্টুরেন্টের রাস্তা দেখিয়ে দিল।টিকেট জনপ্রতি 50,000 রুপিয়া এবং বাচ্চাতের জন্য 25,000।
রেস্টুরেন্টটা বেশ পরিপাটি, বুফে খাওয়ার ব্যবস্থা। খাবার স্থানীয় স্বাদের। বালিনিজদের খাবারও ভাত রিলেটেড, তাই খেতেসমস্যা হয় না।নাসি গোরেং, বালি নাসির স্বাদ আমাদের দেশের মতো।তবে আমি সোজা মাসরুম সুপ আর 'মী গোরেং' (নূডুলস)এ ভরসা রাখি।খাওয়া শেষে গাইড এসে আমাদের নিয়ে যায় ভিতরে।দূরে পাহাড় দিয়ে ঘিরে থাকা হৃদের মাঝে ভাসমান মন্দিরটির অসাধারণ সৌন্দর্যে আমাকে মুহূর্তের জন্য সম্মোহিত করে।অসম্ভব পরিষ্কার লেকটির জল শান্ত এবং বলতে গেলে পুরোপুরি স্থির।হালকা বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ তৈরি করেছে লেকের পানিতে।পরিবেশ যেন মন্দিরকে কিছুটা পরাবাস্তব চেহারা দিয়েছে।এককথায় চারপাশের আবহাওয়ায় এক অদ্ভুত মুগ্ধতা আছে যা নিজে অনুভব না করলে বোঝানো সম্ভব না।
বরুণ জানালো 1633 সালে নির্মিত মন্দিরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 1200 মিটার উপরে।আর এই লেকের নাম বেরাতান। উলুনদানু বেরাতান টেম্পল মানে হ'ল বেরাতান হ্রদের শক্তি বা উৎস মন্দির।মন্দিরটি মেংউই সাম্রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
মন্দির কমপ্লেক্সের ভিতরে অনেক গুলো আলাদা আলাদা মন্দির ছিল।আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে লেকের মাঝে ছোটদ্বীপের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরটিকে।লেকের জলে তার কম্পমান ছবি প্রতিফলিত হচ্ছিল।এখানে ছবি তোলার জন্য সবাইভীড় করে আছে।আমার কাছে মনে হল ছবি তুলে নয়, মনে গেঁথে নেয়া উচিৎ এমন সুন্দরকে।
মন্দির কমপ্লেক্সের ভিতর তিনটি প্রধান মন্দির ছিল।উচ্চতার ভিন্নতা ছিল।মন্দিরেরর নকশায় হিন্দু এবং বৌদ্ধ স্থাপত্যের মিশ্রণদেখা মিলে।বরুণ জানালো সবচেয়ে উঁচু ১১ টি স্তরের মন্দিরটি বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা হয়েছে, সাতটি স্তরের দ্বিতীয় উচ্চতমটিব্রহ্মাকে,তিনটি স্তরের সবচেয়ে ছোটটি শিবকে এবং হ্রদের দেবী দেউই দানুকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এখানে একটি বৌদ্ধ স্তূপওছিল।এই সমস্ত মন্দিরগুলি দেবতাদের সম্মান করার পাশাপাশি এই অঞ্চলে উর্বরতা এবং সমৃদ্ধির আহ্বান জানাতে নির্মিতহয়েছিল।সে হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিলো।প্রফেশনাল গাইডের অবশ্য দায়িত্বযে কোন স্থানকে জীবন্ত করে তোলা।
মন্দির কমপ্লেক্সের ভেতর চমৎকার ম্যানিকিউরড বাগান ছিল।বিশেষ করে বটগাছটা দেখার মতো ছিল।এছাড়াও পুরো এলাকাসিংহ, পেঁচা, সাপ এবং মাছ সহ বিভিন্ন সিমেন্টের মূর্তি দিয়ে সাজানো ছিল।ইচ্ছে করলে রাজহাঁসের প্যাডেল নৌকা ভাড়া নিয়েলেকে বিশ্বের ২০তম সুন্দর হ্রদের সৌন্দর্যে অবগাহন করা যায়।বেরাতান শব্দের অর্থই প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়া।আমার মনে হলো নামের যথার্থতা আছে।
হঠাৎ করে বৃষ্টি আসায় আমরা ছাতা ভাড়া নিলাম বেড়ানোর জন্য।বৃষ্টি এখানে নিয়মিত চিত্র বলে স্থানীয়রা ছাতা নিয়েই আসে।আর পর্যটকেরা ভাড়া নেয়।তবে বৃষ্টিতেও দর্শনার্থী কম নয়।মন্দিরটি মূলত ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতার সাথে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বালিনিজ স্থাপত্য এবং মনোরম অবস্থানের জন্য দেশী বিদেশি দর্শনার্থীদের কাছে এত জনপ্রিয়।ধর্মীয় গুরুত্বের অংশ তো বাদই দিলাম।
মন্দির থেকে বের হয়ে যাবো তখন কিছু স্কুল বাচ্চা এলো আমার সাথে ছবি তোলার জন্য।তাদের এই আগ্রহের কারনঅজানা,হয়তো পোশাকের কারনে।
স্কুলের বাচ্চা(বালি, ইন্দোনেশিয়া )
মন্দির কমপ্লেক্স থেকে কাছে বালি বোটানিক গার্ডেন।যদিও সময় অভাবে আমরা বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশের বন, অর্কিড সংগ্রহএবং বিভিন্ন ঔষধি গাছ সমৃদ্ধ বোটানিক গার্ডেন দেখতে পারিনি।
প্রথম দিনের মতো সমাপ্তি দিয়ে আমরা রওনা দিলাম রিসোর্টের উদ্দেশে।যাওয়ার রাস্তায় একটি বিরাট স্থাপত্য চোখে পড়ে।মহাভারতের যুদ্ধরত দুই চরিত্র। একজন রথের উপরে বসে, আর একজন শূন্য থেকে তাকে আক্রমণ ভঙ্গিতে।রথের উপরে বসে থাকা চরিত্রটি কর্ণ আর আক্রমণ করছে ঘটোৎকচ।ভাস্কর্যটি সম্পর্কে জানতে চাইলে বরুণ বলল বালিনিজরা ঘটোৎকচকেবীরের সম্মান দেয়।কিন্তু উপমহাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঘটোৎকচের পূজা করে না।
এই ভাস্কর্য নিয়ে কথা বলায় বরুণ জানালো মহাভারতের পঞ্চপান্ডবদের নামে এখানে একটি সৈকত আছে — পান্ডোয়া। যেখানে পঞ্চপান্ডবদের এবং দেবী কুন্তীর ভাস্কর্য আছে।জনশ্রুতি আছে যে পঞ্চপাণ্ডবরা এখানে এসেছিলেন তাদের অজ্ঞাতবাসের সময়।তখন ভীমসেনের হাতে নাকি তৈরি হয়েছিল 'বেসাখি' নামে এখানকার সবচেয়ে বড় মন্দিরটি।গল্প শুনতে শুনতে আমাদের রিসোর্টে চলে এলো। উলুন দানু বেরাতান টেম্পল থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার উপরে সময় লাগলো আমাদের।
দ্বিতীয় দিনে আমাদের গন্তব্য উবুদ।আমি কফি লাভার।তাই স্বাভাবিক কারনেই আমি খুব উত্তেজিত কফি ফ্যাক্টরি দেখা নিয়ে।কফির নাম শুনলেই যেন কফির গন্ধ পাই😂।আমাদের গাড়ী কফি ফ্যাক্টরির সামনে গেলে তাদের নারী কর্মী আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যায় কফি বাগান দেখাতে।
কফি বাগান (বালি, ইন্দোনেশিয়া )কফি চিরসবুজ এবং বহুবর্ষজীবী একটি গাছ। কফিগাছ লাগানোর দুই থেকে চার বছরের মধ্যে কফি পাওয়া যায়।গাছ 9/10 মিটার হয়।কফি ফুল সাদা এবং মিষ্টি গন্ধ যুক্ত।কফি প্রথমে গাঢ় সবুজ রংয়ের হয়, পরিণত হলে লাল হয়।আমি পাহাড়ের ঢালবেয়ে নীচে নেমে গেছি কফি বাগানের অনেক ভিতরে।জীবনে প্রথম বার গাছে কফি ছুঁয়ে দেখবো বলে। কফি দেখতে আসলে একধরণের চেরি ফলের মতো,শুধু আকারে একটু ছোট।কফির উৎপাদন নির্ভর করে কফির জাতের ওপর এবং আবহাওয়া ও সিজনের ওপর।
মেয়েটা আমাদের বাগান দেখিয়ে নিয়ে গেল কফি ফল থেকে পানীয় বানানোর প্রক্রিয়া দেখাতে।দেখলাম কেউ চুলার উপরেকফি বিন বড় পাত্রে ভাজছে, কেউ বাছাবাছি করছে, কেউ গুড়া করছে।আমার আগ্রহ দেখে আমি করতে চাই কি না জানতেচাইলো, আমি খানিকটা নাড়ানাড়ি করার সুযোগ লুফে নিলাম।মনে হলো, বাহ্ !! আমি শুধু কফি খেতে পারি না,তৈরিও করতে শিখে গেছি!☺️
এরপর আমাদের নিয়ে গেল তাদের কফি শপে।আমাদের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের ৮ রকমের কফি পরিবেশন করা হলো। বিচিত্র সবস্বাদের কফির স্বাদ নিলাম আমরা।কোনটা রোস্টার করা বিন থেকে ব্ল্যাক কফি, কোনটা নারিকেলের দুধ যুক্ত দুধ কফি।ঢাকার এমন কোন নামি দামী কফি হাউজ নেই যেখানে আমি কফির স্বাদ নি নাই।দেশের বাহিরে এলেও ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডের কফি হাউজে কফি খাই।কিন্তু কফি বাগানের পাহাড়ের উপর প্রাকৃতিক পরিবেশে কফির স্বাদ নেয়ার তুলনা কারো সাথে হয় না।অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতা।
আমরা বেশ কয়েক স্বাদের কফি কিনলাম, নিজেদের এবং গিফটের জন্য।
কফি কেনার সময় সবচেয়ে দামী কফির নাম লুওয়াক বললে আমার এই কফি তৈরির প্রক্রিয়া মনে পড়লো। সিভেট' নামের স্তন্যপায়ী বিড়ালের বিষ্ঠা থেকে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী এই কফি।আমি পড়েছি,কফি বিনস বিড়ালের পেটে যাওয়ার পরফারমেন্টেশন হয় এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে।আর বিড়ালের পাকস্থলীর মধ্যেকার এনজাইম কফি বিনের সঙ্গে মিশে যায়।ফলে অসাধারণ সুগন্ধযুক্ত ও সুস্বাদু কফি পাওয়া যায় তা থেকে।এই কফির খুচরা দাম এক কিলো ৫৫০ ইউরো বা ৭০০ মার্কিনডলার। প্রতি কাপ কফির দাম ৩৫ থেকে ৮০ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬৫০০ টাকা।তবে দাম নয়, প্রক্রিয়াগত কারনে এই কফিতে আমার আগ্রহ নেই।
রাইস ট্রেরেস(বালি, ইন্দোনেশিয়া )
আমাদের গাড়ী কফি ফ্যাক্টরিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলল রাইস ট্রেরেসের দিকে।সত্তরের দশক পর্যন্ত বালির অর্থনীতি ছিলএকমাত্র কৃষি নির্ভর।যা এখন দখল করেছে পর্যটন।বলতে গেলে এখন তাদের কৃষিকাজও পর্যটনের আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।তেমনি এক কৃষি ভিত্তিক স্পটই টেগাল্লাল্যাং রাইস ট্রেরেস।পাহাড়ের গায়ে জুম চাষের আকারের অপূর্ব সুন্দর ধানক্ষেত। যতদূরচোখ যায় সবুজ আর সবুজ।যেন শিল্পীর তুলীতে আঁকা শিল্পকর্মের মতো সুন্দর।পাহাড় কেটে সিঁড়ি মতো ধাঁপে ধাঁপে সাজানোঅপূর্ব সুন্দর ধানক্ষেত।মৃদু বাতাসে সবুজ সিঁড়িগুলো যখন দুলছিল, মনে হচ্ছিল কোন যাদু নগরীতে আমরা চলে এসেছি, না হয় পাহাড় কিভাবে দোলে।আমার মতে,রাইস টেরেস আইকনিক ল্যান্ডস্কেপের ছবি তোলার জন্য উত্তম স্থান।
আমাদের আজকের দিনের শেষ গন্তব্য আর্ট ভিলেজ।তার আগে স্টোমাককে শান্ত করতে হবে বলে রাস্তায় একটা রেস্টুরেন্টেআমরা ব্রেক করলাম।চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রকৃতি আর আধুনিকতার সমন্বয়ে সাজানো এক রেস্টুরেন্ট।ইন্দোনেশীয় স্বাদে রান্না করা ইন্ডিয়ান ফুড খেলাম আমরা।খাবারের স্বাদ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নয়।
লাঞ্চ শেষে রওনা হলাম গ্রামের পথে।যেতে রাস্তার পাশে কমলা বাগান চোখে পড়ল।মূলত ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে রাস্তা গেছে।
আর্ট ভিলেজ বালির প্রাচীন একটি গ্রাম। নানা ধরনের হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। বালিতে যখন ধীরে ধীরে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটে, তখন এই গ্রামকে পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য কারুশিল্পে সমৃদ্ধ করে।
এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পেশা কারুপণ্য তৈরি করা।ইন্দোনেশিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যকে ধারন করে এরা কাঠের ভাস্কর্য কিংবা নানা স্যুভেনির তৈরি করে।আমাদের গাড়ী গ্রামের একটা সো রুম বা বাড়িটিতে গিয়ে থামলো।সেখানে দেখলাম বেশ কয়েকজন কারুশিল্পী কাজ করছেন। বালির কারুশিল্পের বেশ সুনাম আছে।এখানের তৈরি কাঠের বা মেটালের সোপিসঅসাধারণ,যদিও আমাদের কাছে কিছুটা দামী মনে হয়।তবে এদের প্রধান ক্রেতা অস্ট্রেলিয়ান পর্যটক।বালির পর্যটকদের 40%অস্ট্রেলিয়ান।আমরা ঘুরে ফিরে কাজ দেখলাম এবং কিছু জিনিস কিনলাম গিফট দেয়ার জন্য এবং নিজের জন্য।তারমধ্যে হাতে আঁকা তেল ও জল রঙের ছবি তিনটা চিত্রপট ছিলো।পথে আরো কয়েকটি স্যুভেনিয়র শপে দাঁড়িয়েছি দেখার জন্য।
সবশেষে আমরা গেলাম বালির প্রথাগত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে।বালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা নৃত্যশিল্পীদের পারফরমেন্স ছিল দেখার মতো।স্থানীয় শিল্পী হলেও মেকআপ,ড্রেসআপ এবং নৃত্য সব কিছুতে ছিল পেশাদারিত্বের ছাপ।অসম্ভব ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে রিসোর্টের দিকে ফিরলাম।
রিসোর্টে ফিরে সন্ধ্যার পর বের হলাম বালির নাইট লাইফ উপভোগ করতে।কেউ আবার আমার উদ্দেশে নিয়ে সন্দেহের গন্ধ খুঁজবেন না কিন্তু 😂।
আমরা গেলাম একটা মেসেজ পার্লারে।আমার পার্টনার ফুট মেসেজ করালো আর আমি নিলাম ফিস থেরাপি।ছোট ছোট মাছেভর্তি একটা কাঁচের পাত্রে পা ভিজিয়ে বসে থাকা।আমার কাছে সুড়সুড়ি অনুভূতি হয়েছে।
এই দুইদিনে আমার মনে হল,অল্প সময়ের জন্য বালি বেড়াতে এলে কুটায় থাকা ভালো।কুটা টুরিস্ট স্পট গুলোর মাঝখানে পড়ে, এখান থেকে সবদিকে যাওয়া যায়।তবে যারা একদম নির্জন পরিবেশে থাকতে পছন্দ করেন বা নাইট লাইফ পছন্দ নয়,তারানুসা দুয়া বা সানুর বিচ এলাকায় থাকতে পারেন। বালির সবচেয়ে জনপ্রিয় নাইট লাইফ কুটায়। তবে বালির নাইট লাইফ ব্যাংককের নাইট লাইফের মতো খোলামেলা নয়, এখানে কিছু বিষয়ে রাখঢাক আছে।এতে যারা পরিবার নিয়ে মানে বাচ্চাসহ বেড়াতে আসে তাদের অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়তে হয়না।যা ব্যাংককে হয়।আমি খেয়াল করেছি এখানে মেসেজ পার্লার, বারেরভিতর থেকে, বা হোটেলের মাধ্যমে এডাল্ট এক্টিভিটির ব্যবস্থা হয়,ব্যাংককের মতো রাস্তা, শপিং মল, হোটেল করিডোর সহযেখানে সেখানে নয়।এতে কনজারভেটিভ মানুষদের অস্বস্তিতে পড়তে হয় না।
তৃতীয় দিন সকাল থেকে রিলাক্স মুডে ছিলাম, কারন সকালের কোন ট্যুরের পরিকল্পনা ছিল না।বিকালে যাবো উলুয়াটু মন্দিরে সেখানে সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছে।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা গেলাম কুটা বিচে।সূর্যের আলোয় সাগরের পানিতে গাঢ় নীল দেখাচ্ছিল।ঢেউয়ের উচ্চতা আমাদের কক্সবাজার থেকে বেশী।তাই তো সার্ফারদের স্বর্গ বলে ধরা হয় বালির এই সমুদ্র সৈকতকে। নীল পানির আর সাদা বালির সৈকতে রৌদ্রময় দিনও বেশ লাগছে।সমুদ্র স্নান যাকে বলে তা না করলেও,ঢেউের সাথে দাপাদাপি করে মাথার চুল অবধি ভিজিয়েছি।
লাঞ্চ শেষ করার আগেই কল এল আমাদের গাইড সানির।2.30 দিকে আমরা বের হলাম উলুওয়াটু মন্দিরের উদ্দেশে।সাধারণত মানুষ এক সাথে তানার লট আর উলুয়াটু মন্দিরের যায়।যে কোন একটি থেকে সূর্যাস্ত দেখে।আমি দুই স্পট থেকে সূর্যাস্ত দেখতে চাই, তাই দুই মন্দিরে আলাদা দিন যাবো।প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় লাগল আমাদের রিসোর্ট থেকে।
উলুওয়াটু (Uluwatu) বালির সর্বদক্ষিণের একটি এলাকা। ১১ শতাব্দীতে স্থাপিত এই হিন্দু মন্দিরটি ২৩০ ফুট উঁচুতে পাহাড়েরওপর অবস্থিত।আমরা 100000 রুপিয়া দিয়ে এন্ট্রি টিকেট নিলাম কেকাক ডান্স সহ।এরপর সানি আমাদের জন্য নিয়ে এলবালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক সারং এবং স্কার্ফ। যা আমার কাছে মনে হলো দুই টুকরো কাপড়।সে সারং পরিয়ে দিয়ে স্কার্ফটা কায়দা করে বেঁধে দিল কোমরে।আমাদের যেহেতু কাঁধ খোলা পোশাক নয়, তাই স্কার্ফ কোমরে বেঁধেছে।বেগুনী, কমলার কালার কম্বিনেশনটা বেশ লাগছিল।ওদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে কেমন লাগছিল আমাকে তা নিয়ে কোন ভাবনা ছিল না, আমি পরতে পেরেই খুশী😂।তবে আমি শুধু নয়,অন্যরাও আনন্দিত, অধিকাংশ পর্যটকের মুখের হাসিই বলে দিচ্ছিল তা।আর মন্দিরের প্রাঙ্গণ জুড়ে বেগুনী, কমলা পোশাকের দর্শনার্থীদের উপস্থিতি তো উৎসব মুখর পরিবেশ তৈরি করেছে।
মন্দিরে প্রবেশ পথে কয়েকটি গণেশমূর্তি সাজানো ছিল।যেন গণপতিজী দর্শনার্থীদের জন্য অপেক্ষমাণ।মন্দিরে ঢোকার আগে গাইড আমাদের বলে দিলো বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি না তুলতে এবং মাটিতে পড়ে থাকা নৈবেদ্য পা চাপা না পড়ে হাঁটার সময় সেদিকে সতর্ক থাকতে।সে জানালো, উলুওয়াতু মন্দিরকে স্থানীয়ভাবে 'পুরা লুহুর উলুওয়াতু' নামে পরিচিত।'পুরা' অর্থমন্দির।'লুহুর' নামের অর্থ ঐশ্বরিক উৎস' এবং উলু অর্থ "ভূমির শেষ" এবং ওয়াটু মানে"পাথর'। উলুওয়াতু মন্দিরকে বালিনিসরা সমুদ্র মন্দিরও(পুরা সেগারা) বলে।সে জানায়,পূর্ব জাভা থেকে আগত একজন পুরোহিত 'ধ্যাং হিয়াং দ্বিজেন্দ্র' তার আধ্যাত্মিক যাত্রার চূড়ান্ত উপাসনা স্থান হিসেবে এখানে আসেন এবং এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
আমি যখন মন্দিরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ক্যামেরায় ব্যস্ত, তখন বানরের চাটা খেয়ে চশমা হারিয়ে হতবাক।আমার পৃথিবী সাদাকালো করে বানরটা চশমা নিয়ে গাছের ডালে উঠে বসলো।আমাদের গাইড বাদামের প্যাকেট আনতে যতটুকু সময় লাগল তাতেই সে মনের সুখে চশমার কাঁচ খুলে নীচের ফেলে দিল।সেই কাঁচ,ফ্রেম ভাঙা চশমা নিয়ে বালির বাকী সময় কাটাতে হলো।তাও ভালো পুরো ভাঙেনি, নইলে আমার কি যে হতো!! তবে বানরটা আমাকে একটা লেশন দিয়েছে, তা হলো আমার মতো চশমিশদের দুইটা চশমা সাথে রাখা উচিৎ।দুর্ঘটনা হতেই পারে।
মন্দিরের উত্তর এবং দক্ষিণ উভয় অংশ থেকেই সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়।আমরা সূর্যাস্ত দেখার জন্য যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সেটা সাগরের পাশেই,অনেক উঁচুতে।নিচে সাগরের সাদা ফেনার মতো পানি এসে পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ছে।কিছু সময় পরেসূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে গেল সাগর জলে।ধীরেধীরে সূর্যটা হেলে পড়লো, নিমিষেই একেবারে সাগরের বুক ছুঁই ছুঁই লাল সূর্য।লাল সূর্যটার এমন পরিক্রমা বর্ণনাতীত।কিছু ছবি বা ভিডিও করে আমরা শুধু আংশিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে পারি।
সূর্যাস্তের পরপরই কেকাক এবং আগুননাচ শুরু হয়।আমরা চলে এলাম মন্দিরের উন্মুক্ত মঞ্চে বালি সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই কেকাক (Kecak) নৃত্যানুষ্ঠান দেখতে।এটা ফায়ার ডান্স নামেও পরিচিত।পছন্দমত স্থানে বসার জন্য সবাই আগ থেকেই এসে বসেছে।কয়েক মিনিটে পুরো চত্বর ভরে গেল। এই পারফরমেন্স কেবল পর্যটকদের আনন্দ দেয়ার জন্য, এতে আধ্যাত্মিক কোন তাৎপর্য নেই।এই নাচের যাত্রা শুরু হয়েছিল কয়েক যুগ আগে। প্রাথমিকভাবে এই নৃত্যে কেবলমাত্র পুরুষেরা অংশ নিতো।তবে, 1930 এর দশকে 'ওয়াল্টার স্পাইস' নামের একজন শিল্পী এ নৃত্যে কিছুটা পরিবর্তন করেছিলেন, তিনি রামায়ণের একটি বিশেষ অংশ নিয়ে এই নৃত্যনাট্যকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিলেন।তখন থেকে এতে নারীদের অংশ নেয়ার শুরু। তবেসময়ের সাথে কেকাক নৃত্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।তাই প্রাচীন রীতি সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ বলা যায় না।তবে এটি এখনও খুব রঙিন এবং গতিশীল। কেকাকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ পরিবেশনায় এখনো কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না।
আমি এখানে আসার আগেই কেকাক নৃত্যনাট্য নিয়ে পড়ায় আমি বেশ উত্তেজনা নিয়ে আরম্ভের অপেক্ষা করছি।কিছুক্ষণ পর পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের একটি দল দুই বাহু মেলে মঞ্চে আসে এবং বাতাসে হাত নেড়ে তারা মুখে দ্রুতগতিতে 'চক' 'চক’ ধরনের শব্দ কোরাসের মতো শোনায়। তারপর ধীরে অন্য চরিত্রের শিল্পীরা মঞ্চে আসে।তারা রামায়ণের সীতার অপহরণের অংশটা সংলাপবিহীন মঞ্চস্থ করে।এই নৃত্যনাট্য অযোধ্য রাজ্যের রাজপুত্র রাম স্ত্রী সীতা এবং অনুগত ছোট ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে বনে যাওয়া,রাবণের সীতাকে অপহরণ এবং বানরদের রামকে সাহায্য করা সব কিছুর সাথে উলুওয়াতুর মন্দিরের পরিবেশ পুরোপুরি মিলে যায় যেন।
নৃত্যনাট্যের শেষের দিকে মঞ্চে আগুনের মশাল নিয়ে আসে, তখন অন্ধকারে আলোর ঝলকানিতে চারিদিক আলোকিত হয়েযায়।এই নৃত্যনাট্যের মূল বার্তা হলো,ভাল এবং মন্দের মধ্যে কখনও যুদ্ধ শেষ হয় না, এবং ভালো জয় অবধারিত।
বাদ্যযন্ত্র ছাড়া, সংলাপ ছাড়া যে কোন অনুষ্ঠান এতোটা আকর্ষণীয় হতে পারে জানা ছিলো না।অনুষ্ঠান শেষে পারফরমারদের সাথে দর্শকেরা ছবি তুলে,হাত মিলিয়ে তাদের অভিবাদন জানালো অনেকেই।
কায়াক নৃত্য শেষ করে আমরা চলে এলাম জিম্বারান বিচে।উলুয়াতু মন্দির থেকে গাড়ীতে 15/20 লাগলো।আমাদের রিসোর্টথেকে এই বিচের দূরত্ব 12/13 কিলোমিটার।আমরা ট্যাক্সি নিয়েছিলাম দুটো স্পটের জন্য।এখানে সাগরের পাড় ধরে সারি সারিসি ফুড রেস্টুরেন্ট।রেস্টুরেন্টের ভিতরেও বসার ব্যবস্থা আছে তবে মানুষ সাধারণত এখানে আসে খোলা আকাশের নিচে বসে সিফুড খাওয়ার জন্য। সৈকত জুড়ে খাবার পরিবেশন ও বিনোদনের মানে সময় উপভোগের নানান আয়োজন।আমরা বসলামএকদম সাগরের কাছাকাছি টেবিলে।কযেক পা দূরত্বে সমুদ্র ঢেউ ভেঙে সাদা ফেনা ছড়িয়ে দিচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে।টেবিলের উপর সেডদেয়া মোমদানিতে জ্বলছে লাল রঙের মোম।কয়েকটা টেবিল ঘিরে বাঁশের স্ট্যান্ডে বাতি দিয়ে লাভ,বৃত্ত, চতুর্ভুজাকৃতি করে সাজানো। মাথার উপরে তো তারার মেলার বাড়তি পাওনা তো আছেই।এমন পরিবেশে কাঠখোট্টা মনও রোমান্টিক আবেশে মুগ্ধহবেই।আমি সী ফুড লাভার না, আমি এসেছে পরিবেশ উপভোগ করতে।
এখানে সী ফুড অর্ডার দেয়ার আগে ইচ্ছে করলে একুরিয়ামে ভেজানো মাছের চেহারা,সাইজ দেখে অর্ডার দেয়া যায়।দামটা একটুবেশী, তাই যারা বাজেটের বিষয়ে এলার্ড,তারা দেখে শুনে সতর্ক হয়ে অর্ডার দিবেন।তবে আমার মনে হয়েছে স্বর্গীয় উদ্যানে বসেডিনার করতে গেলে ব্যয়টা একটু বেশীই হবে, এটাই স্বাভাবিক।বিশেষ ড্রেস পরা ওয়েটার খাবার পরিবেশন করতে এলে কেমনযেন নিজেকে রাজকীয় অতিথি মনে হলো।খাওয়ার মাঝে সবার টেবিলের মতো আমাদের টেবিলেও এলো শিল্পীরা কাছ থেকেগান শুনাতে।গানের ভাষা না বুঝলেও শারীরিক ভাষায় বুঝতে পেরেছি কোন রোমান্টিক গান হবে।বিভিন্ন মুভির দৃশ্যে এমন রোমান্টিক ডিনার দেখেছি।আজ বাস্তবে সেই দৃশ্যে আমি !! হঠাৎ বিমানের শব্দে তাকিয়ে দেখি একটা বিমান যেন আলতো করে জল ছুঁয়েই গুটি গুটি এগিয়ে গেল।এই বিচ থেকে কাছেই ডেনপাসার বিমানবন্দর। সাগরের গর্জন ও লাইভ মিউজিক শুনতে শুনতে এমন রোমান্টিক ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করার অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করা যাবে না, শুধু অনুভব করা যাবে।
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ