up

সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ(ড্রিম ডেসটিনেশন)






ছোটবেলায় ক্যালেন্ডারে বরফাচ্ছন্ন সাদা পর্বতশৃঙ্গ দেখে দেখে কল্পিত এক সুইজারল্যান্ডের ছবি আঁকতাম আমি, যেখানে সব কিছু সাদা।এমন কি গাছও সাদা😂।আসলে সুইজারল্যান্ড নিয়ে ফ্যান্টাসি আমার সেই পিচ্ছি আমল থেকেই।শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর, সুইজারল্যান্ডের ক্ষেত্রে কথাটা যেন শতভাগ প্রযোজ্য।সুইজারল্যান্ড কারো কাছে ঘড়ি বা চকলেটের দেশ, কারো কাছে আল্পসের বাড়ি বা রেড ক্রসের জন্মস্থান।কিন্তু আমার কাছে সুইজারল্যান্ড হলো দৃষ্টিনন্দন পর্বতশৃঙ্গ, দুর্দান্ত হিমবাহ, প্রসস্ত হ্রদ, মনোরম শান্ত গ্রাম, সবুজ চারণভূমির সম্মিলিত রূপ।মনে হয়,টলটলে নীল জল থেকে উঠে আসা আল্পসের তুষারাবৃত চূড়াগুলি যেন মেঘের মধ্যে প্রবেশ করে। তুষার মুকুট পরিহিত আল্পসের চূড়ার মনোমুগ্ধকর এই দৃশ্যা ও রুপকথার গল্পের গ্রামের মত সাজানো গ্রাম বা বিশাল সবুজের কার্পেটে মোড়ানো এমারেল্ড ভ্যালী সুইজারল্যান্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়া দ্বারা বেষ্টিত আল্পস পর্বতমালার দেশ সুইজারল্যান্ডের নৈসর্গিক সৌন্দর্য পাশাপাশি এখানে আছে হাইকিং, বাইকিং, ক্লিম্বিং, স্কিইং, প্যারাগ্লাইডিং ও স্লেজ গাড়িতে চড়ার সুবিধা।মধ্য-পশ্চিম ইউরোপের পাহাড়ি দেশ সুইজারল্যান্ডের একটি দীর্ঘ শান্তির ইতিহাস রয়েছে একটি যুদ্ধবিহীন দেশ হওয়ার।পাঁচশ বছরেরও বেশি, যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।সেই শান্তির ধারাবাহিকতা এখনো আছে তাই দেশটির রাজনৈতিক অবস্থা ভারসাম্যমূলক ও অত্যন্ত সুস্থির।এদেশের মানুষ এতটা শান্তি প্রিয় যে,দেশটির কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা তারা বোধ করে নাই।

পৃথিবীর স্বর্গ খ্যাত সুইজারল্যান্ড ভ্রমনে যান তাহলে অবশ্যই নিচের দর্শনীয় স্থানগুলোতে যেতে মোটেও ভুল করা উচিৎ হবে না।বিশেষ করে বার্ন, জুরিখ, জেনেভা, লুস্যান 

জুরিখ:

সুইজারল্যান্ডের বৃহত্তম শহর এবং আর্থিক কেন্দ্র জুরিখ  সমৃদ্ধ সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত পর্যটন কেন্দ্র।লিম্মাত নদীর অববাহিকায় তৈরী হওয়া লেক জুরিখের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল এই শহর সুইজারল্যান্ডের পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্যের একদম শীর্ষে। আর কোথাও ভ্রমণ হোক বা না হোক। সুইজারল্যান্ডে পা রাখা প্রত্যেক টা মানুষ একবার হলেও এ শহরে আসে।প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ  পর্যটক এই শহরের অলিগলিতে রেখে আসে তাদের পদচিহ্ন। এখানে ৫০টি যাদুঘর ও ১০০টি আর্ট গ্যালারি আছে।সারাদিনের ঘুরাঘুরিতে ক্লান্ত টুরিস্টদের প্রশান্তি দেয়  লেক জুরিখে নৌকা ভ্রমণ।সুইজারল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে উৎসর্গ করে নির্মিত রুপকথার দুর্গ “সুইস ন্যাশনাল মিউজিয়াম” দেখার কথা ভুললে চলবে না।জুরিখের দর্শনীয় স্থান,- আর্ট গ্যালারী, গীর্জা, একাধিক যাদুঘর, এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সুইস ব্র্যান্ডের পণ্য কেনার জন্য আছে শপিং মল।এছাড়াওএখানে বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চারের জন্য বাইক রাইডিং , হাইকিং, স্কিইং এবং পর্বতারোহণ করা যেতে পারে। জুলাই মাসে সুইজারল্যান্ড ভিজিট করলে অবশ্যই জুরিখ মিস করবেন না।এককথায় জুরিখ টুরিস্টদেরকে এক আলাদা আনন্দের সন্ধান দিতে পারে।

#আরো পড়ুন https://www.prithibirpathe.com/2022/06/blog-post_16.html

জেনেভা:

সুইজারল্যান্ডের পশ্চিম প্রান্তের উপত্যকার সুন্দর ও ছবির মত চমৎকার শহর জেনেভা,ধীর গতির ছুটির জন্য একটি নির্মল পরিবেশ। সুইজারল্যান্ড আর ফান্সের সীমান্তে ছোট এই শহর এমনিতেই অন্যরকম সুন্দর শহর,তার উপর বিশ্বের সবচেয়ে বড় আল্পাইন হ্রদও জেনেভারই দখলে। লেকটিকে শহরের নামেই নামকরণ করা হয়,লেক জেনেভা।এটি সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। আর এ লেকে বিভিন্ন কাপলের উপস্থিতি দেখা যায় বিকাল জুড়ে।এছাড়া পরিবেশবাদী পর্যটকদের জন্য জেনেভা আদর্শ স্থান। কারণ এই শহরের ২০% স্থানই পার্ক। এজন্য একে “পার্কের শহর” বলা হয়ে থাকে। জেনেভাকে “গ্রীন সিটি” বা “সবুজ শহর”ও বলা হয়ে থাকে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার অফিস ও সদর দফতর জেনেভাতে অবস্থিত। যেমন ওর্য়াল্ড টেলিকমিনিকেশনের সদর দফতর, বিশ্বের বিজ্ঞানীদের রিসার্চ ইনষ্টিটিউট, বিশ্ব আবহাওয়া দপ্তর, রেডক্রসের সদর দপ্তর, আইএলও, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সদর দপ্তর ইত্যাদি। জেনেভা শহরে প্রায় ২ থেকে আড়াই লক্ষ লোকের বসবাস।টুরিস্ট বাসে শহরটি দেখতে সময় লাগে মাত্র ২ থেকে ৩ ঘন্টা।এই শহরে টুরিস্টদের পছন্দের এক্টিভিটি হলো, লেকে পাল তোলা নৌকা করে বেড়ানো বা মন্ট ব্ল্যাঙ্কের কাছাকাছি ঢালে স্কিইং করা।

বার্ন:

গ্রামীণ নিখুঁত সৌন্দর্যের সাথে আধুনিক নাগরিক সুবিধার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ইউরোপের সবচেয়ে মনোরম দেশ সুইজারল্যান্ডের রাজধানী শহর বার্ন।মধ্যযুগীয় পুরানো এই শহরে ঐতিহ্যের সাথে বিশ্ব-মানের আধুনিক প্রযুক্তির চমৎকার সংমিশ্রণ ঘটেছে।অপরূপ সৌন্দার্যের লীলাভূমি মধ্যযুগীয় শহর বার্নের ইতিহাস আছে ১২০০ শতকের পুরোনো।বার্নের ঐতিহাসিক সংস্কৃতি তাই দেখার মতো। সুইস রাজধানী বার্নের বুকে বয়ে চলা “এরে নদী” আর পুরো শহরের একটা পুরাতন বিশ্বভাব এই শহরকে দিয়েছে আলাদা মাধুর্য।প্রচুর জাদুঘর আর চিত্রকর্মের গ্যালারিতে সমৃদ্ধ বার্ন শহরটি সকল পর্যটকদের কাছে খুবই পছন্দের এক জায়গা। যেখানে প্রায়ই প্রদর্শনী অনুষ্ঠান হয়ে থাকে আর সেখানে বিভিন্ন চিত্রপ্রেমীদের দেখা যায়।এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে প্রাচীন ক্লক টাওয়ার যাতে চলন্ত পুতুল আছে, একে Zytglogge বলে।একটি শহরের প্রেমে পড়তে আর কি লাগে! অন্য জনপ্রিয় স্থানগুলো হচ্ছে মুনস্টার এবং টাউন হল।ইউরোপের দীর্ঘতম আচ্ছাদিত শপিং এলাকা এই প্রাচীন নগরে অবস্থিত যা চার মাইল দীর্ঘ। 


দ্যা ম্যাটারহর্ণ:

আলপ্স পর্বতমালার উচ্চতম শৃঙ্গ “দ্যা ম্যাটারহর্ণ” সুইজারল্যান্ড-ইতালি সীমান্তে অবস্থিত এই পর্বতের সৌন্দর্য শ্বাসরুদ্ধকর। নিখুঁত পিরামিড আকৃতির জন্য এটি টুরিস্ট আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই আইকনিক চূড়াটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 4,478 মিটার উচ্চতার পাথুরে শিখরে ওঠার শখ মানুষের সেই বহুকাল থেকে।তবে ম্যাটারহর্ণের প্রথম এক্সিপিডিশন ছিল একটি ভয়াবহ বিভীষিকার মতো। ১৮৬৫ সালের  প্রথম এক্সপিডিশনে অংশগ্রহণকারী চারজন ট্রেকারই পড়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন অকালে। এখন প্রতি গ্রীষ্মেই অনেক অভিজ্ঞ ট্রেকার ট্রেক করে দ্যা ম্যাটারহর্ণে। ম্যাটারহর্ণের ঠিক নিচেই আছে “জারম্যাট” নামে ছোট গোছানো এক শহর। সেখানে বাড়িঘর থেকে শুরু করে বেশির ভাগ জিনিস কাঠের তৈরি।এখানে ভ্রমণ কালে মনে হবে তুষারে ঢাকা সাদা পাহাড়ের গায়ে সুইস ক্লাসিক গল্পের সেই ছোট্ট মেয়ে হাইডি বুঝি বা আজও বসবাস করে, ফুলের বনে ছুটে চলে, প্রকৃতির কোলে অবাধ স্বাধীনতা উপভোগ করে, প্রকৃতির কাছ থেকে জীবনের শিক্ষা নেয় বা তুষার চূড়ার দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বোনে। এই শহরে ঢুকতে হলে ছয় কিলোমিটার দূরে যার যার গাড়ি রেখে ঢোকার নিয়ম।এখানে পরিবেশ ঠিক রাখতে সকল প্রকার মোটরচালিত যানবাহন নিষিদ্ধ করেছে সুইজারল্যান্ড সরকার।এখানে যানবাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঘোড়ার গাড়ি ও চার্জে চালিত এক ধরনের গাড়ি, যা শহরের বাতাস দূষিত করে না। সেখানে হর্ন বাজানো একদম নিষিদ্ধ। সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত শহররূপী একটি গ্রাম।শীতের সময়ে স্কিইং করার সময় ৩০০ কিলোমিটার ঢালে চলে যেতে পারে মানুষ। গ্রীষ্মের সময়ে হিমবাহ স্কিইং, পর্বতারোহণ, সাঁতার ও টেনিস খেলা জনপ্রিয়।

লুসার্ন:

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় অংশের প্রবেশদ্বার হচ্ছে লুসারন। এটি সুইজারল্যান্ডের একটি সংস্কৃতিবান, মনোমুগ্ধকর শহর।মন্ত্রমুগ্ধ লুসার্ন গ্রামটি, এক সুন্দর হ্রদ দ্বারা সুসজ্জিত।লেক লুসারনের স্বর্গের মত সুন্দর দৃশ্যাবলী এবং এর নীচেই দেখা যায় অত্যাশ্চর্য আল্পসের চমৎকার দৃশ্য। চিত্রানুগ পুরনো এই শহরটি গাড়ী মুক্ত, এই শহরের মাঝখানে চিত্রাঙ্কন সম্বলিত আচ্ছাদনসহ একটি কাঠের তৈরি মধ্যযোগীয় সেতু আছে যা ইউরোপেরও সবচেয়ে প্রাচীন সেতু। এখানকার ঐতিহাসিক বাড়িগুলো দেয়াল চিত্রে সাজানো থাকে।উদ্ভাবনী নকশার জন্য বিখ্যাত এই শহরে আছে চমৎকার টাউন স্কয়ার। অপরূপ সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর গীর্জা তো আছে।ভ্রমণ বিলাসী মানুষের কাছে সারা বছরই এই শহর জনপ্রিয়।এখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার অবস্থান  পাশাপাশি।এপ্রিল ও মে মাসের টুরিস্টরা লুসার্ন ভিজিট না করলে সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ থেকে যাবে অসম্পূর্ণ।

বাসেল:

বাসেল হল উত্তর-পশ্চিম সুইজারল্যান্ডের রাইন নদীর তীরে অবস্থিত একটি শহর, ফ্রান্স এবং জার্মানির সাথে দেশের সীমান্তের কাছাকাছি।ঐতিহাসিক শহর বাসেল, হিস্টোরি প্রেমীদের দেখার জন্য অবশ্যই আদর্শ স্থান। “The City of Art” নামে খ্যাত বাসেল, একটি প্রাচীন শহর।শহরটি ক্যাপল টুরিস্টদের পছন্দের জায়গা।মধ্যযুগীয় পুরানো এই শহরে ১২ শতকের গোথিক ক্যাথেড্রাল চার্চ,জাদুঘর এবং মার্কেট স্কোয়ারে অদ্ভুত সুন্দর বইয়ের দোকান রয়েছে।16 শতকের ডাচ পণ্ডিত ইরাসমাসের সমাধি রয়েছে। 

সোলোথার্ন:

সুইজারল্যান্ডের উত্তর পশ্চিম প্রান্তের এক শহরের নাম সোলোথার্ন। পর্যটকরা এই শহরে ঢুকেই থমকে যান টাউন স্কয়ারের সামনে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। কারণ সোলোর্থান শহরের মূল কেন্দ্রেই দেখা মিলবে রহস্যময় এক ঘড়ির। সোলোর্থানের এই রহস্যময় ঘড়িতে আছে শুধু ১১টি কাঁটা। সেই হিসাবে এ শহরের ঘড়িতে কখনও বাজে না ১২টা।শুধু তাই নয়, অনেক কিছুতেই ১১ সংখ্যার প্রাধান্য পাওয়া যায়। যেমন- ১১টি জাদুঘর, ১১টি গির্জা, ১১টি ঝর্ণাসহ আরও অনেক কিছু।এখানে সেইন্ট আরসু গির্জা নামে একটি নির্মাণ করা হয় ১৫ শতকে,তার ১১টি দরজা, ১১টি জানালা, ১১টি রো, ১১টি ঘণ্টাসহ ১১ ধরনের পাথরের ব্যবহার।এককথায় সোলোর্থান শহরের সঙ্গে ১১ সংখ্যার সম্পৃক্ততা ৫০০ বছর ধরে। শহরবাসীর মনে ১১ সংখ্যার প্রতি বিশেষ ভালোবাসার কারন হল, একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইলভ নামে এক ব্যক্তি এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন।তাঁর নামকে স্মরণীয় করতেই এই ব্যতিক্রমী আয়োজন।টুরিস্টরা এই শহরে আসে  ১১ সংখ্যার প্রাধান্যতা নিজ চোখে দেখে যেন নিশ্চিত হয়।

ইন্টারলাকেন:

পৃথিবীতে অবস্থিত ছোট একটি স্বর্গের অংশ সুইজারল্যান্ড।  পশ্চিমে থুন হ্রদ আর পূর্বে ব্রিয়েঞ্জ হ্রদের কোলে অবস্থিত সুইজারল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণীয় শহরের নাম ইন্টারলেকেন। ইন্টারলেকেনে আছে প্রায় ৩৫ একরের মতো খোলা জমি।এখান থেকে দেখা যায় আইগার, মঞ্চ, জাংফ্রাউয়ের মতো দারুণ কিছু পর্বতশৃঙ্গ। এটি আল্পস পর্বতের বেসক্যাম্প হিসেবেও জনপ্রিয়। এখানে সময়ে সময়ে বেশ ভিড় জমে উঠে পর্যটকদের।তখন শহরটিতে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পাহাড়ে কোলে টলটলে নীল পানির বিশাল এক হ্রদ, হ্রদের পাশে গড়ে ওঠা মোটরবাইকবিহীন পরিষ্কার আকাশের অলিগলি, ও ঐতিহাসিক ভবনে ভরপুর এই শহর।এটি হানিমুনের জন্য সেরা এবং প্রাচীনতম স্পট। এই পর্যটন কেন্দ্রটিতে, স্কিইং, ল্যান্ডস্কেপ ভিউ, প্যাডলিং এবং প্যারাগ্লাইডিংয়ের কেন্দ্র রয়েছে।পুরো ইন্টারলেকেন ঘুরতে হলে ট্রেন জার্নির বিকল্প নেই; কারণ লেকের পাড় ঘেঁষে অসাধারণ কিছু দৃশ্য আছে, তা শুধু ট্রেন কিংবা প্লেন থেকেই উপভোগ করা সম্ভব। সড়কপথে গেলে এই স্বর্গীয় দৃশ্য উপভোগ করা যাবে কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম। এমনিতে ট্রেনের রাস্তাগুলো অনেক উঁচুতে থাকে যে ট্রেন থেকেই পুরো শহর দেখা যায়। এখানেই ট্রেন জার্নির সার্থকতা। 


টিসিনো:

সুইজারল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিম অংশের শহর টিসিনো। এটি সুইজারল্যান্ডের আরো এক সেরা পর্যটন কেন্দ্র।বরফে ঢাকা পাহাড় এবং অপূর্ব সুন্দর হ্রদের এক নিখুঁত সৌন্দর্যের সংমিশ্রণ।ক্যাপল টুরিস্টদের জন্য সুনির্দিষ্ট কমনীয় সৌন্দর্যের এই সুইস উপত্যকা।এখানে রয়েছে জল ক্রিয়া – স্বপ্নালু নৌকাবিহার ,উইন্ডসরফিং,এবং বিভিন্ন এক্টিভিটি।ডিসেম্বরে সুইজারল্যান্ড হানিমুনের জন্য, বিভিন্ন দেশের ক্যাপলদের কাছে পছন্দের জায়গা।মজাদার খাবার ও ওয়াইনের জন্যও বিখ্যাত টিসিনো।


                                   জাংফ্রোজস:

গ্রীষ্ম বা শীত উভয় ঋতুর জন্যই সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো জায়গা গুলোর একটি জাংফ্রো অঞ্চল। সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রেল ভ্রমণ হল ক্লেইন স্কেইডেক পর্বত থেকে ইগার ও মনচ পর্বতের মধ্য দিয়ে জাংফ্রোজস পর্যন্ত যাওয়া। এই রেল ট্রিপ এর রেলগাড়িটির নাম জাংফ্রুবান।টুরিস্টদের এই ট্রেন আল্পসের শীর্ষে এবং সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যে নিয়ে যায়,যার স্মৃতি টুরিস্ট চোখের ফ্রেমে বন্দী করে রাখে আজীবন।এক বা দুই শতাব্দী আগেও দুঃসাহসী অভিযাত্রীরাই কেবল আল্পস পর্বতারোহণের জন্য যেত। তখন এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য শুধু সেই বীরদের হতো। এখন আর মানুষের অগম্য নয়, সুইস ইঞ্জিনিয়ারিং সেখানে পৌঁছে গেছে – আর সেই জন্যেই বোধহয় সুইজারল্যান্ড প্রায় সবার কাছেই এক কথায় ‘ড্রিম ডেসটিনেশন’।তাই বর্তমানে রেলপথের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, সুন্দর হাঁটার বা বাইকের পথ সব বয়সী বা সব ধরণের পর্যটকের জন্যই এই সৌন্দর্য দর্শন আরামদায়ক ও সহজসাধ্য।গ্রিন্ডেলওয়াল্ড, মুড়েন, লটারব্রুনেন এবং ওয়েঙ্গেন নামের ৪টি চিত্রানুগ শহর এবং ইগার, মনচ ও জাংফ্রু নামের নয়নাভিরাম ৩টি পর্বত নিয়ে জাংফ্রো অঞ্চল গঠিত।



খাবার:

সুইজারল্যান্ডের রান্নার স্টাইল বহুমুখী।ঐতিহ্যবাহী সুইস কুজিন অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলির অনুরূপ।তবে এখানে খাবার খুব দামি।যেকোনো ধরনের সিট ডাউন রেস্তোরাঁয় কোনো খাবার 25 ডলারের নীচে পাওয়া কঠিন। সুইজারল্যান্ডে খাবারে দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং পনির ব্যবহার বেশ।সুইসরা মিষ্টি জাতীয় খাবার পছন্দ করে।তাই তো সুইসরা হল বিশ্বের বৃহত্তম চকলেট ভোক্তা।অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি একজন সুইস বছরে ১১ কেজি চকলেট খায়।সুইসদের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় হল ওয়াইন।  মাটি, বাতাস, উচ্চতা এবং আলোর কারণে সুইজারল্যান্ড বিভিন্ন ধরণের আঙ্গুরের জন্য উল্লেখযোগ্য, তাই এখানের ওয়াইনের সুনাম আছে। 


সুইজারল্যান্ড ট্রেন ভ্রমণ:

পাহাড়, লেক, প্রাকৃতিক শোভা পরিবেষ্টিত সুইজারল্যান্ডের মনোরম ল্যান্ডস্কেপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ট্রেনের বিকল্প নেই; কারণ, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ট্রেন এবং কেব্‌ল কারে চড়ে বাইরের প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলি উপভোগ করা, সে শিহরিত হওয়ার মতো ব্যাপার! সকল পর্যটকরাই বেশ আনন্দের সাথে সুইস রেলভ্রমণ উপভোগ করে এবং নিয়ে যায় সুইজারল্যান্ডের রেল ভ্রমণের সুখময় ইতিহাস।জংফ্রাউ রেল ভ্রমণ তার মধ্য সবচেয়ে আকর্ষণীয়।আল্পস পর্বতের সবচেয়ে চমৎকার দৃশ্য দেখাতে দেখাতে এটি টুরিস্টদের নিয়ে যায় আল্পসের শীর্ষে এবং সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যে।ট্রেনটি যতই মাটি থেকে ওপরে উঠে, মনে হয় আকাশ, মেঘ আর পাহাড়ের শিখর মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব মিলনের সাক্ষী হয়ে চোখ আর মনে প্রশান্তির এক আনন্দমাখা অধ্যায় মুঠোবন্দী হয়।এছাড়া ট্রেনে লুসার্ন থেকে মন্ট্রো যাত্রাপত্রও মন্ত্রমুগ্ধকর।হ্রদ, আল্পস এবং তৃণভূমি পেরিয়ে, বার্নিস ওবারল্যান্ডের মধ্য দিয়ে এই ট্রেন যাত্রা টুরিস্টদের চোখে স্বপনের মতো সুন্দর।

সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের সেরা সময়:

যারা শুধু সিটি ভ্রমণ করতে চায় তাদের জন্য সময়ের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।সুইজারল্যান্ডকে ধরণীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে বসে থাকে সবসময়।তবে যারা স্কি করতে এবং ট্রেইল কভারেজের করতে চান ডিসেম্বর থেকে মার্চ সময়ের মধ্যে যাওয়া উচিৎ।আর যারা শহর দেখা এবং আল্পস পর্বতমালার পর্বতারোহণ করতে চান তারা জুন থেকে সেপ্টেম্বর বেছে নেয়া উচিৎ।সুইজারল্যান্ডে জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল।অনেকের মতে এই সময় সুইজারল্যান্ড বেড়াতে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। এপ্রিল থেকে জুনের মাসও যাওয়া যায়।তবে যারা প্যারাগ্লাইডার এবং হাইকিং করতে আগ্রহী তাদের জন্য গ্রীষ্মকালেই ভালো।


   ভাষা ও সংস্কৃতি:

সুইজারল্যান্ড দেশটি চারটি দেশের কোলে অবস্থিত হওয়ায় এখানের প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের মতো সুইজারল্যান্ডের ভাষা ও সংস্কৃতিও অবাক করার মতো। ভাষার ক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ড একটি আকর্ষণীয় দেশ।সারা দেশে একটি প্রধান ভাষা কথ্য হওয়ার পরিবর্তে, সেখানে চারটি! ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য, সঙ্গীত এবং বিজ্ঞানে অনেক উল্লেখযোগ্য অবদানকারীদের বাড়ি সুইজারল্যান্ডে।এছাড়াও দেশটির শান্তির পরিবেশ ইউরোপে অশান্তি বা যুদ্ধের সময় সৃজনশীল অনেক ব্যক্তিদেরকে  আকৃষ্ট করেছিল।এটাও এখানের বিরল ভাষাগত ঐতিহ্য বজায় থাকার কারন।এছাড়া মনোযোগ আকর্ষক স্থাপত্যের সাথে আধুনিক নান্দনিকতা বা সমসাময়িক শিল্প এবং নতুন-মুখী নকশার অপ্রত্যাশিত সৌন্দর্যের সমন্বয় দেখা যায় সুইজারল্যান্ডে।এখানে প্রায় 1000 জাদুঘর সারা আছে।সংখ্যাটি 1950 সাল থেকে তিনগুণেরও বেশি হয়েছে।এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক পারফরম্যান্সের মধ্যে হল প্যালেও ফেস্টিভ্যাল, লুসার্ন ফেস্টিভ্যাল,  মন্ট্রেক্স জ্যাজ ফেস্টিভ্যাল, লোকার্নো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং আর্ট বাসেল।



বিশেষ টিপস

1.সুইজারল্যান্ডে দেশের মধ্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক এবং সহজ উপায় ট্রেন।

2.SBB অ্যাপ এবং SBB ওয়েবসাইটৈর বেশ হেল্পফুল।

3.অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সুইজারল্যান্ডের আবহাওয়া পরিস্থিতি - বিশেষ করে যারা আল্পসের চারপাশে ভ্রমণ করবে। Meteoblue.com ব্যবহার করলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে।

4.সুইজারল্যান্ডের স্থানীয় মুদ্রা হল সুইস ফ্রাঙ্ক (ইউরো নয়), এবং এটি মার্কিন ডলারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। সাথে কিছু নগত সুইস ফ্রাঙ্ক নেয়া ভালো।যদিও প্রায় প্রতিটি রেস্টুরেন্ট, হোটেলসহ সব জায়গায় ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করে। 

5.ভ্রমণের ব্যয় কমাতে চাইলে শহরের থেকে একটু দূরে থাকুন, যেখানে আপনি সহজেই একটি দ্রুত ট্রেন বা বাসে চড়ে শহরের কেন্দ্রে যেতে পারেন, অথবা হোস্টেলে থাকতে পারেন রুম শেয়ার করে।


ব্যতিক্রমী কিছু তথ্য:

1.সুইজারল্যান্ডে প্রায় ১৫০০ লেক রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, দেশটিতে ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা লেক আছে।

2.সুইজারল্যান্ডের সবখানে বিনামূল্যে সুপেয় পানি পাওয়া যায়।তাই পানি কিনে খেতে হয় না এখানে।

3এখানে এমনও বাড়ি আছে,যেখানে ইলেকট্রিসিটি আছে কিন্তু তারা ব্যবহার করে না।সন্ধ্যায় রাতের খাবার খেয়ে পুরো বাড়ি মোমের আলোয় আলোকিত করে রাখে। 4. 4. 4.সুইজারল্যান্ডে বনজঙ্গলের বাড়িগুলোতে বাতাসের শব্দ, পাখির কাকলি, লেকের পানি, প্রস্রবণের কলতান শুনবে বলে এরা কোনো মিউজিক শোনে না; অবশ্য নতুন প্রজন্ম এর ব্যতিক্রম। 

5.সুইজারল্যান্ড জাতিসংঘের বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থাগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, সুইসরা ২০০২ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে যোগ দিতে নারাজ ছিল। 



প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য যা অনন্তকাল ধরে পৃথিবীর বুকে সাজানো ছিল, সুইজারল্যান্ডে এসে সেই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে হাজার টুরিস্ট রোমাঞ্চিত হয়, অভিভূত হয়। জীবনের অপূর্ব সেই সজল, সবুজ মুহূর্ত গুলো যেন এক একটি ফ্রেমে বাধানো অমূল্য ছবি হয়ে যায়, হয়ে যায় সারা জীবনের এক অমূল্য সঞ্চয়। আর সেই ছবির ফ্রেম গুলোয় নিজেকে দেখে কতো মানুষ জীবন জুড়ে স্মৃতি রোমন্থন করে যায়, সেই অপূর্ব সৌন্দর্যের ছবি যেন অবচেতন মনে রয়ে যায়, স্মৃতিতে বসবাস করে চলে জীবনভর, সুইস সৌন্দর্য মানুষকে তেমনি করে সম্মোহিত করে, দ্রবীভূত করে।এককথায় ভ্রমণ ডায়েরির পাতায়,পৃথিবীর স্বর্গ সুইজারল্যান্ডের অসাধারণ নৈসর্গিক সবুজ জমি বা তুষারাবৃত আল্পস পর্বত প্রত্যেক টুরিস্টের স্বপ্নের গন্তব্য।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post