দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে সিংহ বা চিতার সাথে দেখা করা এবং হাঁটার বা জিরাফকে নিজ হাতে পাতা খাওয়ার শখ আমাদের দীর্ঘ দিনের।কিন্তু সহসা সেটা পূরণ হওয়ার নয়।তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাঘদের সাথে তো দেখা করা বা খাওয়ানোর মাঝ দিয়ে তো কিছুটা শখ মিটানো যায়। তাও আবার হাতের নাগালেই,যেখানে বছরে দুইবার যাওয়া হয়। তাই আমরা টাইগার টেম্পলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
কেউ চাইলে ব্যাংকক থেকে প্রাইভেট গাড়ী ভাড়া করেও চলে আসতে পারে ব্যক্তিগত ভাবে। ট্যাক্সিতে ৩০/৪৫মিনিটের পথ। জনপ্রতি ৬০০ BHT দিয়ে টিকেট কাটা যায় গেটে।তবে আমার মতে সেটা খুব ব্যয়বহুল।
টাইগার টেম্পল বা ওয়াট ফা লুয়াং তা বুয়া ইয়ানাসাম্পান্নো থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের সাই ইয়ক জেলার একটি থেরবাদ বৌদ্ধ মন্দির।যা 1994 সালে বন্য প্রাণীদের জন্য অভয়ারণ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।এই আশ্রমের তাদের বেশিরভাগ ইন্দোচীন প্রজাতির বাঘ।
থাইল্যান্ডের এই বাঘ মন্দিরটি মূলত এক ধরণের অভয়ারণ্য বলা যায়,যা দর্শকদের সাথে প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ বা সম্পর্ক তৈরি করতে সহায়তা করে।থাইল্যান্ড জুড়ে বিভিন্ন নামে আরো কয়েকটি বাঘের মন্দির রয়েছে। তার মধ্যে জনপ্রিয় হল টাইগার কিংডম চিয়াং মাই, টাইগার কিংডম ফুকেট এবং শ্রীরাচা টাইগার চিড়িয়াখানা।তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ওয়াট ফা লুয়াং তা বুয়া ইয়ানাসাম্পান্নো।সবগুলো মন্দিরে বাঘের সাথে পর্যটকদের ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ আছে।আমার জানা মতে,এই বিখ্যাত আশ্রমটিতে 135 টিরও বেশি বাঘ ছিল।এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র বলে অনেক ট্যুর অপারেটরই এখানে ব্যাংকক থেকে ডে ট্যুরের আয়োজন করে।
আমরা যখন টাইগার টেম্পলের গেটে নামি তখন দুপুরের সূর্যের তেজ নিম্নগামী।আমাদের টিকেট কাটার ঝামেলা নেই, সে দায়িত্ব এজেন্সির ছিলো।গেট থেকে অনেক দূর হাঁটতে হয় আশ্রমে পৌঁছাতে।
যদি আপনি সন্ন্যাসীদের খাওয়ানোতে অংশ নিতে চান বা অভয়ারণ্য ভালো করে ঘুরে দেখতে চাইলে সকালে আসা উচিৎ।এই টেম্পলের মূল আকর্ষণ হলো প্রচুর সংখ্যক বাঘের আবাসস্থল এটা যাদের তিনদিকে টিলা দিয়ে ঘেরা গুহার মতো জায়গায় রাখা হয়।ভিতরে গাছপালা এবং একটা ছোটখাটো জলাধার আছে।যাতে পরিবেশটা যথেষ্ট প্রাকৃতিক রূপ পায়।বড় বিষয় হলো পর্যটকেরা বাঘের সাথে ছবি তোলার জন্য খাঁচায় প্রবেশ করতে পারে।দর্শনার্থীদের বাঘগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। টাইগার টেম্পলের বাঘগুলো সন্ন্যাসীদের দ্বারা পরিচালিত হয় যার কারণে বাঘগুলি এত শান্ত ছিল।তাই পর্যটকরা নিরাপদে তাদের কাছে যেতে পারে,গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে, খাওয়াতে পারে।কোন কোন পর্যটক বাঘকে একটি লাঠিতে মাংসের টুকরো গেঁথে খাওয়ানোর এডভেঞ্চার নেয়।এছাড়াও এখান পর্যটকেরা ইচ্ছে করলে বাঘের বাচ্চাকে দুধের বোতলে করে খাওয়া এবং খেলাতে সুযোগ দেয়া হয়।যা অন্য কোন চিড়িয়াখানা বা অভয়ারণ্যের এমন অভিজ্ঞতা নেয়ার সুযোগ আছে বলে আমার জানা নেই।এই আনন্দের অংশীদার হতে হলে আপনাকে বাড়তি টাকা দিতে হবে।তবে কেউ কেউ এটাকে পর্যটন ফাঁদ মনে করলেও,আমি মনে করি প্রাণীদের দেখাশোনা করার জন্য তাদের তহবিল দরকার।তাই এটা সমর্থনযোগ্য।
ভিতরে বাঘদের চিকিৎসার জন্য ছোটখাটো হাসপাতাল, তথ্য কেন্দ্র,বাঘের বাচ্চাদের জন্য পরিচর্যা কেন্দ্র রয়েছে।বাঘ সংরক্ষণের পাশাপাশি এই মন্দির বাঘ এবং অন্যান্য পশু সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে।এককথায় বন্য প্রাণীদের সাথে মানুষের যোগাযোগ নিরাপদ করার কাজ করে।
আশ্রমটি ঘুরে দেখার পর,আমার পার্টনার আমার জন্য ৩টি অবিশ্বাস্য বাঘের সাথে ৩০ মিনিট কাটানোর জন্য TBH1000 দিযে বিশেষ টিকেট কেটে নেয়।আমাকে যখন গাইড ভিতরে নিয়ে যায়,তখন দেখি অনেকগুলো বাঘ ঘোরাফেরা করছে,কোনটা স্নান করছে ছোট একটা ঝরনায়, কয়েকটা খেলছে সঙ্গীর সাথে,কোনটা আয়াসী ভঙ্গিতে শুয়ে আছে।চারপাশে এত বাঘ আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক অভিজ্ঞতা ছিল।বাঘগুলোর রাজকীয় চেহারা এবং অঙ্গভঙ্গী দেখে প্রথমে বেশ লাগছিল।কিন্তু কাছে গিয়ে এক মহারাজের গায়ে হাত দিয়ে আমার কাঙ্ক্ষিত ফটোগ্রাফের পোজ দিতেই, সে নড়েচড়ে উঠে হালুম, হালুম শব্দ করতেই আমি ঘাবড়ে গেলাম।সত্যি কথা বলতে কি আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।আমি গাইডের হাত শক্ত করে ধরে ছিলাম।আমার গাইড ঝানু বাঘ বিশেষজ্ঞের মতো তার গায়ে হাত দিয়ে কি যেন বললো,সে আবার শান্ত চোখে আমার দিকে তাকালো।তারপর গাইড আমাকে মজা করে বললো ওতো তোমাকে ভয় দেখাতে চায় নাই, তোমার পোজ ভালো হচ্ছিল সে কথা বলছিল😂।এরপর গাইডের সহযোগিতায় তার সাথে খানিকটা বন্ধুত্ব হলো। অবশেষে আমি সিঙ্গেল করে এবং তিনজন মহারাজের মাঝে আমি হাসি মুখে আমার কাঙ্ক্ষিত ফটোসুট শেষ করে বের হলাম। আমাকে ভিতর থেকে বের হওয়ার সময় বাঘের হাঁড়ের একটা লকেট সহ কালো ফিতার মালা গলায় পরিয়ে দেয়া হলো দুঃসাহসিক কাজের জন্য😂।মজা করলাম।মূলত বিশেষ পেমেন্টের মাধ্যমে ভিতরে যাওয়া সবাইকে এই গিফট দেয়া হলো।
পর্যটকদের সুরক্ষার জন্য গাইডের খুব সতর্ক।যদি হঠাৎ করে বাঘগুলো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।যা যে কোন শিকারী প্রাণীর মধ্য সবসময় সম্ভাবনা থাকে।তবে বেশী ভাবনার কিছু নেই।তারা সত্যিই টেম, এবং যতক্ষণ না আপনি প্রোটোকল মেনে চলেন যা আপনাকে গাইড ব্যাখ্যা করছে,আপনি ভাল থাকবেন।বাঘের সাথে গল্প করতে গিয়ে তার লাঞ্চ না হওয়ার জন্য 😂সতর্ক থাকতে চেষ্টা করুন।
টাইগার টেম্পলে পর্যটকদের পোশাক কোড মানতে হয়।বিশেষ করে মহিলা পর্যটকদের খোলামেলা পোশাকের বিশেষ কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।কারণ এটি একটি ধর্মীয় মঠ,ধর্মীয় স্থানের পবিত্রতার বিষয়ে শ্রদ্ধা রাখতে হয়।তবে কেউ যদি সে ধরনের পোশাক পরে আসে,তাহলে তাদেরকে মঠ চাদরের মতো কাপড় দিয়ে থাকে নিজেকে ঢেকে রাখার জন্য। এছাড়াও, উজ্জ্বল লাল, জাফরান রং বা কমলা রঙের পোশাক এড়ানোর উপদেশ দেয়া হয়।কারণ এসব রঙ বাঘদের উত্তেজিত করতে পারে।
টাইগার টেম্পলের স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্য অনেকে আছেন যারা অনেক ভাষায় কথা বলতে পারেন।এতে বোঝা যায় এখানের টুরিস্ট আকর্ষণ কতটা বেশী।পর্যটকদের সুবিধার্থেই বহু ভাষী গাইড নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আরেকটা বিষয় আমি খেয়াল করেছি, তা হলো বাংলাদেশি পর্যটক আমরা ছাড়া কেউ নেই, ভারতীয় কয়েকজন।যেখানে ব্যাংককে বাংলাদেশীদের বেড়ানোর হার চোখে পড়ার মতো।তার মানে টাইগার টেম্পল সম্পর্কে বাংলাদেশীদের তেমন জানা নেই।(ইউরোপীয়ও) এবং যেকোনো সমস্যায় আপনাকে সাহায্য করতে পারেন।
বাঘের কাছাকাছি যাওয়ার মতো সুযোগ দেয়া এমন একটা টাইগার পার্ক নিয়ে কিন্তু বিশ্ব মিডিয়াতে বিতর্কও আছে।আমি Netflix সিরিজের 'টাইগার কিং' দেখে এই ধরনের কেন্দ্র বা আশ্রমগুলোর সম্ভাব্য ব্যবসায়িক মডেল এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো সম্পর্কে যা বুঝেছি, তাতে এই আশ্রম নিয়েও প্রচুর বিতর্ককে সুযোগ রয়েছে।কিছু মিডিয়ার তথ্য মতে এখানে বাঘেরা লাঞ্ছনার শিকার হয়।এখানে বাঘদের দমন করতে এবং তাদের স্বাভাবিক হিংস্রতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হ্যান্ডলাররা পশুদের প্রতি আপত্তিজনক আচরণ করে। তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরম রোদে বসে থাকতে বাধ্য হয় এবং নির্দেশ না মানলে প্রায়ই কাঠের লাঠি বা ক্লাব দিয়ে আঘাত করা হয়।এছাড়া বন্য অঞ্চলের বাঘের বাচ্চারা যেখানে প্রায় দুই বছর ধরে তাদের মায়ের সাথে থাকে,সেখানে এই মন্দিরগুলিতে দুই সপ্তাহের কম বয়সে বাচ্চাগুলিকে তাদের মায়ের থেকে আলাদা করা হয়।এটা করা হয় মা বাঘগুলিকে দ্রুত প্রজননের জন্য তৈরি করা ও বাচ্চাগুলোকে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহারের করার সুবিধার জন্য।যা পশু আইন বিরোধী।তবে এটাও সত্যি বিশ্ব মিডিয়া যতগুলো অভিযোগ করেছে তার কিছু কিছু পুরো এশিয়াতে প্রাণীদের প্রতি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণ বলা যায়।যদিও এমনটা হওয়া উচিৎ নয়।
আমি টাইগার টেম্পলে গিয়েছিলাম ২০১২ সালে।আমার ভিজিটের মাত্র কয়েক বছর পরে, থাইল্যান্ডের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদফতর পশুদের সাথে দুর্ব্যবহার এবং মাদকদ্রব্যের ব্যবহার সহ কয়েকটা অসৎ আচরণ চিহ্নিত করেছে।ফলে মন্দিরটি জনসাধারণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তখন বিষয়টা ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ পায় এবং থাইল্যান্ডের বন্যপ্রাণীর পর্যটন শিল্পের খ্যাতি চিরকালের জন্য কলঙ্কিত ছিল।
তারপরও আমার মতে অভিযোগগুলো সংশোধনের শর্ত দিয়ে আশ্রমটিকে পরিচালনা করতে দেয়া যেতে পারতো।তাহলে Instagram এর পোষ্ট বা পারিবারিক ফটো অ্যালবামের জন্য একটি দুর্দান্ত শট পেতে মরিয়া সারা বিশ্বের পর্যটকদের সাথে সেলফির জন্য শান্তভাবে বসে থাকা বাঘগুলো হতে পারতো বিশ্ব সেরা মডেল☺️(আমার ব্যক্তিগত মতামত,আমি কোন প্রাণী বিশেষজ্ঞ নই)।
0 মন্তব্যসমূহ