ত্রিপুরা ভারতের রাজ্য হলেও এখানের প্রধান ভাষা বাংলা হওয়ায় এবং এখানকার মানুষের খাবার,চেহারা,ধর্মীয় আচার, পোশাক ইত্যাদি সব একরকম হওয়ায় ত্রিপুরায় গিয়ে মনে হলো বাংলাদেশের কোন অংশেই আছি।এমনকি এখানে কোন কোন দোকানদার বাংলাদেশী টাকাও রাখে।আমি নেপালি প্রথম দেখেছি টাকায় কেনাকাটা করা যায়।তার কারন অবশ্য ওরা বলেছে বাংলাদেশে নেপালি শিক্ষার্থীরা আসে তাদের দরকার হয় তাই।আর এরা বললো সীমান্ত বাজারে কেনাকাটায় সহজ হয়।তবে এখানে বাঙালী ছাড়াও ত্রিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, মনিপুরী, চাকমা,ও মিজু সম্প্রদায়ের সহ আরো অনেক সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে।তাদের নিজস্ব ভাষা আছে।
ত্রিপুরা নামটির উদ্ভব ত্রিপুরার পৌরাণিক রাজা ত্রিপুরের নামানুসারে। ‘ত্রিপুর’ ছিলেন যযাতির বংশধর দ্রুহ্যের ৩৯তম উত্তরপুরুষ।আবার কারো কারো মতে, ত্রিপুরা নামটির উৎস হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত দশমহাবিদ্যার একতম ত্রিপুরাসুন্দরী।তবে ত্রিপুরা নামের উদ্ভব নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সৌন্দর্য নিয়ে কোন বিতর্ক নেই।
ত্রিপুরায় দর্শনীয় অনেক জায়গা রয়েছে।তবে এখানের মূল আকর্ষণ হলো স্থাপত্যশিল্প এবং লেক বা দীঘি।আধুনিকতার চাকচিক্য না থাকলেও প্রাকৃতিক শান্ত পরিবেশ টুরিস্টদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট।
আমরা অবশ্য কোন পরিকল্পনা করে ত্রিপুরা বেড়াতে আসি নাই,এসেছি মূলত আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে, কয়েকটা দিন পারিবারিক ছুটি কাটাতে।তাই আগরতলা এয়ারপোর্টে নেমে হোটেল,ট্যাক্সি নিয়ে মাথায় কোন বাড়তি চাপ ছিলো না।ছোটখাটো বিমানবন্দর হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং নিয়ম শৃঙ্খলাও বেশ।যা একজন টুরিস্টকে প্রথমে দেশ বা শহরটি সম্পর্কে গুড মেসেজ দেয়।দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের এয়ারপোর্ট সেটি দিতে ব্যর্থ হয়।
এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ীতে আত্মীয়ের বাসা যেতে যেতে শহরটা যতটুকু দেখলাম তাতে মনে হলো গোছানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা শান্ত ছোট্ট শহর।গাড়ীর হর্নের বাড়াবাড়ি নেই, নেই ঢাকার রাস্তার মতো বিশৃঙ্খল যানবাহনে মাথা নষ্ট করা জ্যাম।রাস্তার উপর অনেক উঁচু করে বানানো পুরানো কালের ট্র্যাফিক বক্স আমার কাছে বেশ লেগেছে। ট্র্যাফিকের এই রাজকীয় অবস্থানের কারনে তাদেরকে রাস্তার রাজা মনে হয়েছিল😂।
যে কারনেই আসি না কেন নতুন কোন দেশ বা শহর দেখার লোভ কে সামলাতে পারে।আর আমি তো হলাম এই বিষয়ে প্রচণ্ড লোভী,যে কোথাও গেলে চারদেয়ালের ভিতর ঘুম ছাড়া এক ঘণ্টাও কাটাতে চাই না।তাই আগরতলার কয়েকটি দর্শনীয় জায়গা দেখার পরিকল্পনা করি।
প্রথম দিন গাড়ী নিয়ে চলে গেলাম নীরমহল।নীরমহল ত্রিপুরার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।আগরতলা থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরের নীর’ বা জলের মাঝে স্থাপিত স্থাপনাটি ত্রিপুরার অন্যতম স্থাপত্যকীর্তি। প্রায় পাঁচ দশমিক তিন বর্গকিলোমিটার আয়তনের রুদ্রসাগরের মাঝে ত্রিপুরার মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য আট বছরে এই অসাধারণ মহলটি তৈরি করিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানি’ ১৯৩০ সালে মহলের কাজ শুরু করে এবং আট বছর কর্মযজ্ঞের পর ১৯৩৮ সালে ভবনটির উদ্বোধন করা হয়। ভারতের রাজস্থানের উদয়পুরে ঠিক একই রকম একটি প্রাসাদ রয়েছে।প্রাচীনকালের রাজা বাদশাহদের জীবনযাপন যেমন বিচিত্র, বিলাসবহুল, তেমনি তাঁদের সৌন্দর্যবোধও অসাধারণ। মুঘল-ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে নির্মিত এই নীরমহল তেমনি এক রাজকীয় স্থাপনা যা মহারাজদের গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন অবকাশ যাপনের জন্য নির্মাণ করা হয়।নীর মহলের দুটি অংশ।একটি হলো মূল অংশ অন্যটি হলো নিরাপত্তাবাহিনীর জন্য দুর্গ। মূল অংশের আবার দুই ভাগ-বাইরের কক্ষ এবং অন্দরমহল।বাইরের অংশ হলো রাজা ও তাঁর অনুসারীদের জন্য।বাইরের কক্ষগুলোর মধ্যে বিশ্রামঘর, খাজাঞ্চিখানা,দাবা খেলার ঘর ও নাচঘর উল্লেখযোগ্য।আর রাণী ও অন্যদের জন্য অন্দরমহল।
নীরমহলের অন্দরমহলটি ছিলো বেশী সুন্দর।এর ভিতরের সিঁড়িতে নৌকা বাঁধা যায়। নীরমহলের সৌন্দর্য যেমন মানুষকে আকৃষ্ট করে,তেমনি এর দুঃখজনক অতীতও মানুষকে ব্যথিত করে।প্রচুর অর্থ ব্যয়ে করে নির্মিত এই প্রাসাদ মাত্র সাত বছর ব্যবহার করে ৩৯ বছর বয়সে অকাল মৃত্যু বরণ করেন মহারাজ।এরপর অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিলো এটি।
১৯৭৮ সালে ত্রিপুরার তথ্য, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসে নীরমহল।১৯৯৫-৯৬ সালে সংস্কারের পর এটি আকর্ষণীয় হয়। বর্তমানে মহলের ভেতর একটি জাদুঘরও চালু করা হয়েছে।প্রতিবছর লাইট অ্যান্ড লেজার শোর মাধ্যমে প্রাসাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। এছাড়া প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে রুদ্রসাগর লেকে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
আরেকদিন বের হলাম আগরতলা শহর দেখতে।প্রথম থেকে ঠিক করা ছিল বেশী জায়গায় যাবো না।যাবো শুধু দুইটা প্রাসাদ দেখতে।আর গাড়ীতে আসা যাওয়ার পথে যতটা শহরটা দেখা যায়।প্রথমে গেলাম উজ্জয়ন্ত প্রাসাদে।তারপর কুঞ্জবন প্রাসাদে।
#উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ:
মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুর মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে উজ্জয়ন্ত প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৯ সালে শুরু হলেও শেষ হয় ১৯০১ সালে।তৎকালীন সময়ে এই সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণে ব্যয় হয় ১০ লাখ ভারতীয় রূপি।
আগরতলা শহরের মূলকেন্দ্রে প্রায় আধা মাইল এলাকাজুড়ে নয়নাভিরাম দ্বিতল এই প্রাসাদটিতে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। মাঝেরটির উঁচুতা ৮৬ ফুট।রাজকীয় প্রাসাদের প্রবেশ পথ রাজকীয় না হলে কি চলে!তাই তো প্রাসাদে ঢোকার পথের মাঝখানে পড়ে ফোয়ারা আর ভাস্কর্যসমৃদ্ধ একটি চমৎকার বাগান।বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি দিয়ে সাজানো গোছানো ছায়াঘেরা দুইটি দীঘি আছে প্রাসাদের দুই পাশে।বাহ্যিক সৌন্দর্যের অসম্ভব মুগ্ধতার রেস প্রাসাদে অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায়ও ধরে রাখে। প্রাসাদটির যেমন সৌন্দর্যে যেমন আভিজাত্যের ছাপ মিলে, নামেও আছে গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব।হবে না কেন! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেয়া নাম বলে কথা! যেমন- শ্বেতমহল, লালমহল, সদর বাড়ি, তহবিল খানা, আরাম ঘর, পান্থশালা প্রভৃতি।বর্তমানে প্রাসাদটি রাজ্যের বিধানসভা হিসেবে ব্যবহিত হচ্ছে।
#কুঞ্জবন প্রাসাদ:
আগরতলা কুঞ্জবন প্রাসাদ মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্যের নির্মান করেন।এই প্রাসাদের কাজ শুরু হয় ১৯০৯ সালে শেষ হয় ১৯২৩ সালে।উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের একমাইল উত্তরের এই কুঞ্জবন প্রাসাদ উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের মতো আরেকটি চমৎকার স্থাপত্যকর্ম।কোনটির সৌন্দর্যের তুলনা কোনটি সাথে করা যাবে না, দুটোর স্থাপত্যশৈলীতেই আছে নিজস্বতা।রাজকীয় অতিথি এবং মহারাজদের অবকাশ যাপনের জন্য তৈরি এই প্রাসাদে বহু জ্ঞানী গুণী ও প্রতাপশালী মানুষের পা পড়েছিল।তার মধ্যে ১৯২৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একজন।তবে এখন এটি
ত্রিপুরা রাজ্য গভর্নরের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার হয়।
#উদয়পুর:
আগরতলা থেকে দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার দূরের উদয়পুর মন্দির ও দীঘির শহর বলেই পরিচিত।উদয়পুরের প্রধান আকর্ষণ ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির।আমি অবশ্য উদয়পুরে গিয়েছি এক আত্মীয়ের বাড়ীর উদ্দেশ্য।আমি বাড়তি উপভোগ করেছি এই শহরের সৌন্দর্য।এই মন্দিরটি ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির হিসেবেও পরিচিত। এটি ৫১ সতীপিঠের অন্যতম। কথিত আছে মহারাজা ধন্যমাণিক্য ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে একটি টিলার ওপর মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এখানে মহারাজা কল্যাণমাণিক্য একটি দীঘি খনন করান, যার নাম কল্যাণসাগর। জনশ্রুতি আছে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বিসর্জন’ ও ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস উদয়পুরের কোন মন্দিরের পটভূমিকায় রচনা করেছিলেন।
#এছাড়া উদয়পুরে গুণবতী মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, গোপীনাথ মন্দির, ত্রিপুরেশ্বরী ভৈরব মন্দির, মহাদেব দীঘি, ধনী সাগর ঘুরে দেখতে পারেন।
সময় এবং সুযোগের অভাবে ইচ্ছে থাকার পরও দেখতে পারি নাই কয়েকটি আকর্ষণীয় জায়গা।যেমন:
#সিপাহীজলা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি:
আগরতলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে এই অভয়াশ্রম। বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, লেক নিয়ে গড়ে উঠা এই অভয়াশ্রমটিতে যেমন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পশু পাখি। ১৫০ প্রজাতির স্থানীয় পাখি ছাড়াও কিছু বিরল প্রজাতির পশুও আছে।যেমন-ক্ষুদ্র লেজবিশিষ্ট বানর, ক্যাপড লেঙ্গুর, চশমাপরা লেঙ্গুর প্রভৃতি।
#কমলাসাগর লেক :
পঞ্চদশ শতাব্দীতে খনন মহারাজা ধন্য মানিক্যের খনন করে কমলাসাগর লেক। এটি আগরতলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে।অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ বেষ্টিত এই লেককে কেন্দ্র করে অনেক পর্যটক আসে।
#ডাম্বুর লেক:
সবুজে ঘেরা নয়নাভিরাম ডাম্বুর লেক আগরতলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে। ৪১ বর্গ কিলোমিটারের এই লেকের মাঝে ছোট ছোট ভূখণ্ডকে এক একটি দ্বীপ মনে হয়।এমন ৪৮টি দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পাখিদের কলকাকলি পরিবেশকে করেছে আরো মোহনীয়।এই লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বাহারি ছোট নৌকা।
#জাম্পুই হিলস:
আগরতলা থেকে প্রায় ২১৮ কিলোমিটার দূরে জাম্পুই হিলস।অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর শীতল আবহাওয়ার জন্য জাম্পুই হিলস হয়ে উঠেছে ত্রিপুরা রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর একটি।
এছাড়াও ছবিমুড়া, উনকোটি সহ অনেক সুন্দর সুন্দর মন্দির দেখা হয়নি সময় অভাবে।
ত্রিপুরায় দুই ধরনের খাবার প্রচলিত- আদিবাসী মেনু,বাঙালি মেনু।তবে আগরতলার অধিকাংশ মানুষই বাঙালি যারা সাধারণউত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মানুষ। ভাত,মাছ, শাকসবজিই যাদের প্রধান খাবার।মাটন, মুরগির মাংস এবং অন্যান্য আমিষ জাতীয়খাবারগুলি রাজ্যের মানুষের মধ্যে বেশ প্রচলিত।তবে এখানে সকল প্রকার সবজি ও সবজির পাশাপাশি মাংসেরও ভর্তা তৈরি হয়যা ত্রিপুরার খাবারের তালুতে একটি স্বতন্ত্র স্বাদ যোগ করে।আর আদিবাসীদের নিজস্ব খাবারের মেনু আছে।সবমিলিয়েবাংলাদেশিদের খাবার নিয়ে কোন সমস্যা হয় না।বলতে গেলে বিদেশে বসে দেশি খাবারের স্বাদ নিতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ