টোল দেয়া জন্য সারিবদ্ধ গাড়ীর পেছনে আমাদের গাড়ী দাঁড়ালে গাড়ীর গ্লাস নামিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রমত্তা পদ্মার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর রঙের দ্বিতল ইট-পাথরের কাঠামোর পদ্মা সেতুকে দেখতে দেখতে ভাবলাম কি বিশেষত্ব আছে এই সেতুর,বিশ্বের সেরা কোন স্থাপনা এটি নয়, সৌন্দর্যের বিচারেও আহামরি কিছু নয়,তারপরও সারাদেশের মানুষের আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দু এখন এই সেতু।যারা দেখার সুযোগ পাচ্ছে তারা ছুটে আসছে দেখতে, আর যারা পাচ্ছে না তারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে।সেতুকে ঘিরে মানুষের এই অনুভূতি ও উচ্ছ্বাসের কারণ বুঝতে হলে যেতে হবে এই সেতুর জন্ম ইতিহাসে।অনেক বাধা উপেক্ষা পার করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক কাজ শেষ হয়েছে।আমি রাজনীতি বুঝি না, বুঝতেও চাই না।তাই এসবে কারণ আমি বুঝি না এবং সে আলোচনা একপাশেই থাক।আমি বুঝি চ্যালেঞ্জকে জয় করার বাঙালির আজন্মের অদম্য স্পৃহার বিজয় প্রতীক এবং আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছি এই সেতু।তাই এই সেতু শুধু রড, সিমেন্ট ও পাথরের তৈরী কোন অবকাঠামো নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৬ কোটি মানুষের আবেগ,ভালবাসা।
তবে পদ্মা সেতু যে শুধু বাংলাদেশীদের আত্মসম্মান আর ভালোবাসার প্রতীক তা নয়।ছোটখাটো কিছু বিশ্ব রেকর্ডও গড়েছে।বিশ্বের ১২২তম এই সেতুর মতো পৃথিবীর অন্য কোনো সেতুতে ১২০ থেকে ১২২ মিটার গভীরে পাইল প্রবেশ করাতে হয়নি,এই সেতুতে পিলার ও স্প্যানের মাঝে ১০০ টন ওজনের ৯৬টি বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। যা আর কোথাও হয়নি।তাই রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পরোধক হয়েছে সেতুটি।১৪ কিলোমিটার এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনতে হয়েছিল,যা পৃথিবীর কোথাও প্রয়োজন হয়নি।
টোলের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গাড়ি চলতে শুরু যখন গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখলাম বিকালের নরম আলোয় প্রমত্তা পদ্মাকে বেশ শান্ত মনে হলো উপর থেকে।আমরা চেয়েছিলাম সূর্যাস্তের সময় ব্রিজ পার হবো, কিন্তু জ্যামে পড়িনি তাই টাইমিং হলো না।তারপরও পদ্মা সেতু থেকে পদ্মার জলের ঢেউয়ে উপর সূর্যের আলোতে যে সোনালি জলতরঙ্গের নান্দনিক দৃশ্যও অতুলনীয় সুন্দর।
পড়ন্ত বেলায় তেজ কমে যাওয়া সূর্যটা পদ্মার জলে ছড়িয়ে দিচ্ছিল সোনালী আভা। গোধূলিলগ্নে বা পড়ন্ত বিকালের এমন মায়া জড়ানো অপূর্ব মুহূর্ত সত্যিই দারুণ উপভোগ্য।
ক্লান্ত সূর্যটা ধীরে ধীরে হেলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে।আর সূর্যের মায়াবী রশ্মি যেন পদ্মার জলে মিশে একাকার।জলের উপর সূর্যের প্রতিচ্ছবিতে মনে হচ্ছিল সূর্যটা ঢেউের আঘাতে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে।লালচে কমলা রং এর সূর্যটা যেন জলের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে।গাড়ীর গতি কমিয়েও ২০/২৫ মিনিটের বেশি থাকা গেল না ব্রিজের উপর।
জাজিরার টোল প্লাজা থেকে বের হলে রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন ধরনের ফুল ফল ও ঔষধি গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে। আর রাস্তার বিভাজকের ওপর লাগানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ।আমার দেখা মতে দেশের অন্য কোনো সেতু বা রাস্তার ধারে এমন ভাবে পরিকল্পিত বাগান নাই।ঢাকা চট্টগ্রাম রোডের বিভাজকে ফুল গাছ লাগানো হয়েছে চমৎকার ভাবে।তবে সেই সৌন্দর্যও এখানের সৌন্দর্যের কাছে ফিকে মনে হবে।এই গুলো শুধু সৌন্দর্যের উৎসই নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখবে।
আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল জাজিরা টোল প্লাজা পার হয়ে একটা রেস্তোরাঁয় চা, কফি যা মিলবে তা নিয়ে বসে ব্রিজে সন্ধ্যার বাতি জ্বলে উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করা।তারপর রাতের দৃশ্য উপভোগ করে বাড়ি ফেরা।কিন্তু রাস্তার সৌন্দর্যে আমরা এত্ত মুগ্ধ হলাম যে শুধু চলতেই ইচ্ছে করলো মনে হলো ইউরোপের কোন রাস্তার ধরে গাড়ী চলছে, বাংলাদেশ মনে হচ্ছে না।রাস্তার দুই ধার যেমন সবুজ ছায়ায় ঘেরা, তেমন সড়ক বিভাজকের উপর নানা রঙের ফুল ফুটে আছে।কোন এক অজানা মায়া যেন দূর থেকে হাতছানি দিচ্ছিল।আমার বিশ্বাস আমার মতো যারা এপাড় এসেছে ব্রিজ দেখতে তারা সবাই ক্ষণিকের জন্য হলেও এমন সৌন্দর্যে বিস্মিত হয়েছেন এবং উপলব্ধি করতে পারছেন আমরা যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নতি করছি জ্যামিতিক গতিতে।
সময়ের বিবেচনায় ফেরার তাড়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাড়ীর গতি আমাদের কমাতে হলো।রাস্তার পাশের ছোট্ট চায়ের দোকানে আমাদের চা সন্ধ্যাযাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম।আমার কাছে বরাবরই যাত্রা পথে চা বিরতির জন্য এমন দোকান পছন্দ। কারণ ঢাকায় আমরা সবসময়ই অভিজাত কফিসপে কফি খাই।কিন্তু এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ ঢাকায় কোথাও পাওয়া যাবে না।খোলামেলা পরিবেশে গাছের নীচে বেঞ্চে বসে চা খাওয়ার মজাই আলাদা।
চা খেতে খেতে দোকানী চাচার সাথে গল্প জমে গেল।ওনার সাথে পদ্মা সেতু নিয়ে কথা তুলতেই তার গলার স্বরেই আবেগ ধরা পড়লো।আনন্দে উত্তেজনায় অনেক গল্প করালো।ওনার কাছে শুনলাম,পদ্মা সেতুর এই পাড়ে মানে জাজিরায় একটা তাঁত পল্লী প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে।এতে দেশীয় এই শিল্পটির জন্য খুব ভালো খবর।বিদেশি কাপড়ের দাপটে এই শিল্প প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে।এছাড়া এতে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও হবে।তবে দোকানী সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত কম সময়ে ঢাকা যাওয়া যাবে, তাই।কারণ তার দুই ছেলে ঢাকায় চাকরি করে।সে ফেরিতে আগে সময় লাগত ২/৪ ঘণ্টা।এখন গাড়িতে ৬/১০ মিনিট লাগে।গল্পে গল্পে কখন চারিদিক অন্ধকার হলো খেয়ালই করিনি।এবার ফেরার পালা।
টোল প্লাজা থেকে দূরে থাকতেই নজরে পড়লো ব্রিজের লাইটিং।প্রথম যে দিন বাতি জ্বালানো হয়েছিল সেদিনের ভাইরাল হওয়া ছবিটি নিজের চোখের সামনে দেখে মনে হলো ছবিটা আগে আমার না দেখা থাকলে ভালো হতো।তাহলে আমার চোখ দুটো এমন সৌন্দর্যে বিস্মিত হতো।তারপরও আমি তাকিয়ে ছিলাম গ্রাম থেকে শহরে প্রথম পা দেয়া মানুষের মতো।
ফেরার পথে ড্রাইভারকে বললাম গাড়ীর গতি ২০শে রাখতে।গাড়ীর খোলা জানালা দিয়ে পদ্মা কালো জলের ছোট ছোট ঢেউের উপর বৈদ্যুতিক বাতির আলোর ছটা পড়ে অদ্ভুত মোহনীয় দৃশ্যের অবতারণা করেছে।মনে মনে ভাবলাম এই পদ্মা আমাদের বাংলা সাহিত্যেকে দীর্ঘকাল থেকে রসদ জুগিয়ে সমৃদ্ধ করেছিল।সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পদ্মা’ কবিতা ‘হে পদ্মা আমার,তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।একদিন জনহীন তোমার পুলিনে,গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে...' বা কবি নজরুল ইসলামের ‘পদ্মার টেউ রে- মোর শূন্য হৃদয় নিয়ে যা যা রে....' আরও কতশত কবিতা, গান হয়েছে।যা এই নদীর তীরের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে।শুধু তাই নয় পদ্মা আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকেও উজ্জীবিত করেছিল।তাই তো ষাটের দশকের জনপ্রিয় ছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।' এবার আরেকটি নতুন পালক যোগ হলো পদ্মার তাজে 'পদ্মা সেতু'।
0 মন্তব্যসমূহ