এডভেঞ্চার প্রিয় বাংলাদেশি ট্র্যাভেলারদের কাছে পার্বত্য এই জেলা অসম্ভব জনপ্রিয়।যারা পাহাড়ের গহীনে সবুজের নিজেকে হারাতে চায় তারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানে আসে বারবার। অনেকের কাছে শীত বান্দরবান বেড়ানো সেরা সময় মনে হয়।আবার কেউ কেউ বর্ষাকে বেছে নেয়।আমার কাছে মনে হয় বান্দরবানের মতো পাহাড়ি পরিবেশে বেড়ানো নিদিষ্ট সময় লাগে না, সুযোগ পেলেই আসা যায়।শীতে কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রাকৃতি যেমন অতুলনীয়, তেমনি বর্ষার বৃষ্টির ছোঁয়ায় পাহাড় যেন গাঢ় সবুজের রঙে নিজেকে মেলে ধরে আপন সাঁজে।তবে তারপরও আমাকে নিদিষ্ট সময় বলতে বাধ্য করলে বলবো বর্ষার শেষ, শীতের শুরুতে বান্দরবানের সৌন্দর্যের সাথে স্বাচ্ছন্দ্যের মিলন ঘটে বেড়ানো জন্য।চারিদিকে সবুজের হাতছানি আর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে প্রকৃতির রাজ্যে নিজেকে হারানোর অনুভূতিই অন্যরকম।
আমার মতে,বান্দরবান বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গভূমি আর পাহাড়ি আদিবাসীরা সেই স্বর্গীয় সৌন্দর্যই অংশ বিশেষ।উন্নত ট্র্যাভেলাররা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পিয়াসী নয়, তারা ভিন্ন সামাজিক জীবনধারা, সংস্কৃতি, জীবন বৈচিত্র্যেরও অনুরাগী।সেই দিক থেকে বান্দরবানের ভিন্ন ভাষার এগারোটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও জীবনধারা এখানের আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
বান্দরবানের নামেরও একটা জনশ্রুতি আছে।স্থানীয়দের কাছে বান্দরবানের নামকরণের পেছনের কাহিনীতে জানলাম এখানে একসময় অসংখ্য বানর ছিল।বানরগুলো আশেপাশের জঙ্গলে সারিবদ্ধভাবে যেত খাবারের সন্ধানে এবং সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসতো।এই অঞ্চলে বানরের এমন অবাধ বিচরণের কারণে এই অঞ্চলের মারমা সম্প্রদায়েরা তাদের ভাষায় ‘ম্যাগসি’ বলত। বাংলায় ম্যাগ অর্থ-বানর এবং সি অর্থ-বাঁধ (বান)। পরবর্তী সময়ে কালের বির্বতনে এ জায়গার নাম হয় বান্দরবান।তবে মারমা ভাষায় বান্দরবানের নাম 'রদ ক্যওচি ম্রো'।
পাহাড়ের ফাঁকে আটকে থাকা তুলার মতো মেঘ আর চারপাশের সবুজের সমারোহ এবং সকাল-বিকেলে দিগন্ত রেখায় লাল, কমলা, কালো,নীল রং প্রতিযোগিতা দেখার জন্য বান্দরবানে পর্যটকের ভীড় সবসময়ই থাকে।এই টুরিস্টরা আমার মতে দুই ধরনের- প্রকৃতি প্রেমী,এডভেঞ্চার প্রিয়।যারা শুধু প্রাকৃতি প্রেমী তারা যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো টুরিস্ট পয়েন্টে বেড়িয়ে সন্তুষ্ট থাকে।আর যারা এডভেঞ্চার প্রিয় তারা দুর্গম বা ওয়াইল্ড বান্দরবানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।
প্রকৃতি প্রেমী টুরিস্টের জন্য দর্শনীয় স্থান:
🌹নীলগিরি
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উচ্চতার নীলগিরি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র। বান্দরবান শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে এই পর্যটন কেন্দ্র পর্যটকদের কাছে স্বপ্নীল একটি নাম,যা না দেখলে বান্দরবানের সত্যিকার সৌন্দর্যই দেখা হয় না।চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। দুচোখ যেদিকে যায় শুধু সবুজ আর সবুজ,এ যেন সবুজের সমুদ্র।এখানে মেঘের লুটোপুটিতে নিজেকে হারানো যায় মেঘের রাজ্যে।ঘন মেঘের চাদরে জড়ানো প্রকৃতির মাঝে শুয়ে শুয়ে রাতের তারা, জোনাকিপোকা আলোর মিছিল বা ঝিঝিপোকার গান শুনতে চাই রাত কাটানোর ব্যবস্থা আছে নীলগিরিতে।সেনা নিয়ন্ত্রিত নীলগিরির কটেজগুলোও নামও বেশ আকর্ষণীয়-আকাশনীলা, মেঘদূত এবং নীলাতানা ইত্যাদি।নীলগিরির পাশেই আছে আদিবাসী সম্প্রদায় ম্রো পল্লী।বিপন্ন এই আদিবাসীদের জীবন বৈচিত্র্য,সংস্কৃতি খুব কাছ থেকে দেখা যায় এখানে।আকাশ পরিষ্কার থাকলে নীলগিরিতে দাঁড়িয়ে রক্তিম বর্ণে রাঙা সূর্যের বিকেলবেলা পাহাড়ের আড়ালে ঢুপ করে লুকিয়ে পড়া সূর্যাস্তের অবর্ণনীয় সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়।এছাড়া সকালবেলায় আকাশে লাল, কমলা রঙের আবীর ছড়িয়ে সূয্যিমামার আবির্ভাব দেখা যায়।সেনা তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বলে এখানে নিরাপত্তার কোন ইস্যু নেই।
🌹চিম্বুক:
সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রায় ২৫০০ ফুট উচ্চতার চিম্বুককে বাংলাদেশের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত বলা হয়।বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরের এই পাহাড় দাঁড়িয়ে চারিদিকের সবুজের সাথে মেঘের মাখামাখির অপূর্ব দৃশ্য বর্ণনাতীত সুন্দর।এখানে পাহাড়ের দুই পাশে শুধু সবুজ আর সবুজ।বর্ষায় চিম্বুক গেলে তো কিছুক্ষণ পর পর টুকরো টুকরো মেঘ এসে ঘিরে ধরে।যেন তারা সিক্ত অভিবাদন জানায় টুরিস্টদের।তখন মেঘের নেমে আসা দেখে মনে হয় মেঘের স্বর্গরাজ্য।দার্জিলিং এর মতো না হলেও এখানে মেঘের হালকা ছোঁয়া যেন মেঘ ছোঁয়ার অনুভূতি আনে।তাই চিম্বুককে বাংলার দার্জিলিং বলে অনেকে।চিম্বুকে যাওয়ার পথও রোমাঞ্চকর। আঁকাবাঁকা ও সর্পিল পাহাড়ি পথে সাঙ্গু নদীকে সাথে নিয়ে যেতে হয় এই মেঘের রাজ্যে।যাত্রা পথের দুই ধারের দৃশ্যই মুগ্ধ করে যে কোন টুরিস্টকে।চিম্বুককে সরকারি দুটি রেস্ট হাউজে থাকা যায়।
🌹বুদ্ধ ধাতু জাতি মন্দির:
বান্দরবান শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে বালাঘাটা এলাকায় প্রায় ১৬০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন বৌদ্ধ ধাতু জাদি বা স্বর্ণ জাদী।বুদ্ধ ধাতু জাতি মন্দিরের আরেক নাম স্বর্ণমন্দির।বান্দরবানে বসবাসরত ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ ১৪টি সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছেও বৌদ্ধ ধাতু স্বর্ণ জাদী তীর্থস্থান। প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্যাগোডাটি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর বৌদ্ধ মন্দির।চমৎকার নির্মাণশৈলী, কারুকার্য, স্বর্ণখচিত এই মন্দিরের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মিয়ানমার, শ্রীলংকাসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে কারিগর বা শিল্পী আনা হয়েছে। সুউচ্চ পাহাড়ের চুড়ার তৈরি সুদৃশ্য এ প্যাগোডায় ধর্মানুরাগী ও পর্যটকদের ১২৩টি সিড়ি বেঁয়ে উঠতে হয়।জাদিতে রয়েছে ছোট, বড় প্রায় শতাধিক বৌদ্ধ মূর্তি।এসব মূর্তির কিছু স্থানীয়ভাবে নির্মাণ করা হলেও বেশির ভাগ মূর্তি আনা হয়েছে শ্রীলংকা, চীন, মিয়ানমার, নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। বৌদ্ধ জাদি এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে একটি ছোট পুকুর,যা দেবতা পুকুর নামে পরিচিত।পুকুরের মাঝখানে ধ্যানরত বৌদ্ধমূর্তি সাদৃস পাথুরে প্রাকৃতিক মূর্তি এবং উচ্চতর পর্বতের উপর প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি হওয়ায় এই পুকুরকে ঘিরে বেশ কিছু আধ্যাত্মিক জনশ্রুতি আছে। স্থানীয় বৌদ্ধ, হিন্দু ধর্মানুরাগীদের মাঝে।আধুনিক ধর্মীয় স্থাপত্যের নিদর্শন এই প্যাগোডা শুধু সৌন্দর্যের বা ধর্মীয় কারণে নয়,এখান থেকে বান্দরবানের বালাঘাটা উপশহর ও এর আশপাশের সুন্দর নৈসর্গিকদৃশ্য দেখা যায় বলে এত টুরিস্ট প্রিয়।প্রতি বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে বসে মেলা।
🌹শৈল প্রপাত:
বান্দরবানের সবচেয়ে সুবিধাজনক বা কাছের ঝর্ণা শৈলপ্রপাত।শৈল প্রপাত মিলনছড়ি এলাকায় যা বান্দরবান শহর থেকে থানচিগামী সড়কের চার কিলোমিটারের মধ্যেই।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সৃষ্টি এই ঝর্ণার পানি খুবই স্বচ্ছ এবং হীম শীতল।বর্ষাকালে এ ঝর্ণা এতটা উচ্ছল থাকে,তখন এখানে নামা দুস্কর।সময় নিয়ে এলে এখানে দুর্গম পাহাড়ের কোল ঘেষা আদিবাসী বম সম্প্রদায়ের সংগ্রামী জীবন যাপন কাছ থেকে দেখা যায়।তাদের তৈরি তাঁতের কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী কেনা যায়।এছাড়া এখানে স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত মৌসুমি ফল পাওয়া যায়,যা সম্পূর্ণ অর্গানিক।
🌹বগালেক:
সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২০০-৩০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বিস্ময়কর বগালেক বান্দরবানের অন্যতম আকর্ষণ।এটিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক হ্রদ ধরা হয়।বান্দরবান শহর থেকে রুমা বাজার হয়ে বগালেক যেতে হয়। রুমা বাজার থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের এই লেক প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। স্বচ্ছ নীল জলের এই লেকের নাম নিয়েও আছে চমৎকার গল্প।কিংবদন্তির এই বগালেক সৃষ্টির কারণ এখনো অজানা।পাহাড়িরা এটিকে দেবতার লেকও বলে।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব এই আধার রুপকথার কোনো স্থানের মতোই সুন্দর।এখানে সাধারণত টুরিস্ট আসে শীতকালে।লেকের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিচিত্র আকৃতির পাথর গুলো দেখতে অদ্ভুত।আগে এখানে ট্যাকিং করে যেতে হতো এখন মোটরসাইকেল কিংবা জিপগাড়িতে করেও যাওয়া যায়।রাতের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এখানে জেলা পরিষদের রেস্ট হাউজ এবং স্থানীয়ভাবেও আরো দুটি গেস্ট হাউজ আছে।চাঁদের আলোয় কিংবদন্তি বগালেকের সৌন্দর্য বর্ণনাতীত সুন্দর।
🌹মেঘলা:
বান্দরবান জেলা শহরে প্রবেশের ৪/ ৫ কিলোমিটার আগে পড়ে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স।মেঘলা বান্দরবানের প্রথম আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র।আগে বান্দরবান দেখাতে বিশাল লেকের ওপর আকর্ষণীয় দুটি ঝুলন্ত ব্রিজ দেখাতো প্রথম।টুরিস্টদের বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে ক্যাবল কার, ট্যুরিস্ট ট্রেইন, শিশুপার্ক, সাফারি পার্ক, চিড়িয়াখানা, পাহাড়ের নিচের কৃত্রিম লেক এবং নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা।রাতে থাকার জন্য আছে রেস্ট হাউজ।এ ছাড়া ছোট্ট পরিসরে গড়ে তোলা চা বাগান যা টুরিস্টদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ।
🌹সাঙ্গু নদীতে নৌকা ভ্রমণ
সাঙ্গু নদীর অপর নাম শঙ্খ।বান্দরবান শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি সাঙ্গু নদীর দুই পাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অপরূপ।পাহাড়, বন ও ঝরনাকে সঙ্গী করে এই নদীতে বেড়ানো সময় প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য ছাড়াও নদীর তীরে পাহাড়িদের বিশেষ কায়দায় তৈরি টংঘর এবং তাদের জীবন বৈচিত্র্য দেখা যায়। শহর থেকে একটু দূরে ভাটির দিকে গেলে শীতামুড়া পাহাড় বা উজানে তারাছা রেঞ্জের নৈসর্গিক সৌন্দর্য সত্যি অসাধারণ।শহরের বাজার সংলগ্ন সাঙ্গু ব্রিজের নিচে এবং কালাঘাটা এলাকা থেকে নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত বোট চুক্তিতে নিয়ে সাঙ্গু নদীতে বেড়ানো যায়।
🌹লামা মিরিঞ্জা
সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে মিরিঞ্জা পর্যটন কেন্দ্র প্রায় এক হাজার ৫০০ ফুট উচুতে।বান্দরবানের লামা-আলীকদম সড়কের ১৬ কিলোমিটার দূরত্বের এই পর্যটন কেন্দ্র থেকে পাহাড়ের কোলঘেঁষে বয়ে চলা মাতামহুরী নদীর সর্পিল গতি, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ সহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আকর্ষণীয় এই পর্যটন কেন্দ্রে অনেক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়।অবশ্য গাড়িতে উঠা যায়।
0 মন্তব্যসমূহ