ট্রেকার আর এডভেঞ্চারপ্রেমীদের মন বান্দরবানের নীলাচল পাহাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা, চিম্বুক বা নীলগিরিতে শুয়ে শুয়ে চাঁদের আলোয় অবগাহন করা, স্বর্ণ মন্দিরের উপর থেকে আকাঁবাঁকা পাহাড়ি পথে দৃষ্টি হারানো বা শৈল জলপ্রপাতের শীতল জলে নেমে মাতামাতি করেই তৃপ্ত হতে পারে না।তাদের চাই আরও বেশি কিছু,চাই দূর্গম ওয়াইল্ড বান্দরবানকে ছুঁয়ে দেখা।তাই তো তারা চায় পাহাড়ের চূড়ার জলের প্রাকৃতিক বগালেকে সাঁতার দিতে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে সেলফি তুলতে,পাহাড়ের গা বেঁযে নেমে আসা রিজুক ঝর্ণায় স্নান করতে,রেমাক্রী বড়পাথর বা দেবতাপাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে পাগলের মতো ক্যামেরা সাটার্র টিপতে বা নাফাকুম জলপ্রপাতে নেমে ক্রেজী ফটোসেশান করতে।
এডভেঞ্চার প্রেমীদের জন্য বান্দরবানের ওয়াইল্ড দর্শনীয় স্থান গুলো হলো:
নাফাকুম/বড়পাথর
বাংলদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জলপ্রপাতগুলোর মধ্যে নাফাখুম অন্যতম।দুর্গম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রহস্যময় থানচিকে বলা হয় বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার।থানচির প্রত্যন্ত এলাকা রেমাক্রিতে পাহাড় ও বনের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা সাঙ্গু নদীতে নাফাখুম।যেখানে পাহাড়, আকাশ, নদী ও ঝর্ণা মিলেমিশে একাকার।নাফাখুম যাওয়ার রোমাঞ্চকর পথে সৌন্দর্য নয়নাভিরাম সুন্দর।এখানে সবুজ পাহাড়ের গায়ের সাথে লেপটে থাকে সাদা মেঘের পোজ। নাফাখুমের পাশেই আরেকটি জলপ্রপাত আছে রেমাক্রি জলপ্রপাত নামে।নাফাখুম যেতে হয় বান্দরবান শহর থেকে পাহাড়ি পথে ৮৫ কিলোমিটার দূরের থানচি হয়ে।তারপর থানচি থেকে নৌকায় রোমাক্রি, রোমাক্রি থেকে শ্বাস রুদ্বকর ট্রেকিং করে পাহাড়ের ঢাল ধরে বন-জঙ্গল হয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটার রাস্তা।দূরত্ব প্রায় ১১-১২ কিলোমিটার।যাওয়ার পথে ছোট ছোট কয়েকটি বিপদজনক খাল-ছড়াও পার হতে হয়।নিরাপত্তা স্বার্থে সঙ্গে একজন স্থানীয় গাইড নিতে হয়।অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা,নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও নানা রকমের দুর্ঘটনার ভয় থাকার পর এডভেঞ্চার প্রিয় ট্র্যাভেলারদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা নাফাখুম।
বগালেক:
সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২০০-৩০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বিস্ময়কর বগালেক বান্দরবানের অন্যতম আকর্ষণ।এটিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক হ্রদ ধরা হয়।বান্দরবান শহর থেকে রুমা বাজার হয়ে বগালেক যেতে হয়। রুমা বাজার থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের এই লেক প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। স্বচ্ছ নীল জলের এই লেকের নাম নিয়েও আছে চমৎকার গল্প।কিংবদন্তির এই বগালেক সৃষ্টির কারণ এখনো অজানা।পাহাড়িরা এটিকে দেবতার লেকও বলে।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব এই আধার রুপকথার কোনো স্থানের মতোই সুন্দর।এখানে সাধারণত টুরিস্ট আসে শীতকালে।লেকের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিচিত্র আকৃতির পাথর গুলো দেখতে অদ্ভুত।আগে এখানে ট্যাকিং করে যেতে হতো এখন মোটরসাইকেল কিংবা জিপগাড়িতে করেও যাওয়া যায়।রাতের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এখানে জেলা পরিষদের রেস্ট হাউজ এবং স্থানীয়ভাবেও আরো দুটি গেস্ট হাউজ আছে।চাঁদের আলোয় কিংবদন্তি বগালেকের সৌন্দর্য বর্ণনাতীত সুন্দর।
রুমা রিজুক ঝর্ণা
রিজুক, রেমাক্রি ওয়াহ এবং তেছরী প্রপাত-তিন চঞ্চলা চপলা অপরূপা পাহাড়ি মেয়ের নাম।রিজুক অনেক উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি মেয়ে।যা সাঙ্গু নদীতে আছড়ে পড়ে এক বিশাল ও প্রবল ঝর্ণাধারা রূপে। রেমাক্রি ওয়াহ এবং তেছরী জলপ্রপাত দুটি রিজুকের মতো উচ্ছ্বল না হলেও প্রবল জলধারা হয়ে ঝমঝম শব্দে জল নূপুর বাজিয়ে সাঙ্গু নদীতে নেমে আসে।বর্ষায় সাঙ্গু নদীতে ছোট বড় অসংখ্য জল ধারা ঝমঝম শব্দে ঝড়ে পড়ে আশপাশের পাহাড় থেকে।রুমা থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে পাহাড়ের ওপর থেকে জলপ্রপাতের ঝড়ে পড়ার দৃশ্য দেখা যায়। রিজুক ঝর্ণার হিমশিতল স্বচ্ছ পানি খুবই ঠান্ডা।রিজুক ঝর্ণা এডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের কাছে খুব পছন্দের জায়গা।
আমিয়াখুম
মিয়ানমার সীমান্তের পাশেই নাক্ষিয়ং স্থানে এই জলপ্রপাতটি অবস্থিত। ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্রতা এই জলপ্রপাতের বিশেষ আকর্ষণ।পাথর আর সবুজে ঘেরা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবল বেগে নেমে আসা দুধসাদা রঙের ফেনিল জলরাশি।অবিরাম ধেয়ে চলা জল নূপুরের শব্দতরঙ্গ যেন ধ্যান মগ্ন প্রকৃতির মাঝে চঞ্চলা কোন পাহাড়ি মেয়ের উচ্ছ্বাস। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর এই জলপ্রপাত দেখতে লোকালয় ছেড়ে অনেক কসরত করে যেতে হলেও সার্থক। প্রকৃতি যেন এখানে অপার সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে বসে আছে ট্র্যাভেলাদের জন্য।
জীবননগর
ঘন মেঘের চাদরে স্বল্প সময়ের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায় জীবন নগরে।বান্দরবান থেকে ৫২ কিলোমিটার এবং চিম্বুক থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে জীবননগর।বান্দরবান থানছির আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। জীবননগরের প্রধান অবশ্য ঘন কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলোছায়ার খেলার প্রকৃতির অপরুপ সৌর্ন্দয। মেঘ আর রোদের লুকোচুরি খেলায় নিজেকে হারানোর আনন্দ বর্ণনা করার জন্য কোন শব্দই যথেষ্ট নয়।
প্রান্তিক লেক
বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-কেরানীহাট মহাসড়কের হলুদিয়ার কাছে এই প্রান্তিক লেক। প্রায় আড়াই একর পাহাড়ি এলাকাজুড়ে অপূর্ব সুন্দর এই লেকের অবস্থান।সবুজ বনানীর মাঝে প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা এই লেকের নির্জন নিরিবিলি পরিবেশে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতে প্রকৃতি প্রেমী টুরিস্ট মাত্রই পছন্দ করবে।প্রান্তিক লেকে যাওয়ার রাস্তা উন্নত থাকা শর্তেও খুব কম টুরিস্ট এখানে আসে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন
নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এই উপবন।যান্ত্রিক কোলাহল থেকে দূরে নির্জন নিরিবিলি পরিবেশে বসে জীবনের হিসাব মিলানোর যথার্থ পরিবেশ।এখানে বনের মাঝে লেকের ওপর আকর্ষণীয় একটা ঝুলন্ত সেতু আছে।ঘন গাছগাছালির ছায়া আর অচেনা পাখির কিচিরমিচিরে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
কেওক্রাডং
সমুদ্র পৃষ্ট হতে প্রায় তিন হাজার ১৭২ ফুট উচঁ কেওক্রাডং পাহাড়।আগে বই পুস্তক এবং সরকারি তথ্যমতে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ধরা হতো কেওক্রাডংকে।কিন্তু পরবর্তীতে জরিপ এটিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়া ঘোষণা করা হয়।এতে সহায়তা করে ন্যাচারাল অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব ও নর্থ আল পাইন বাংলাদেশের সদস্যরা।রুমা উপজেলা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কেওক্রাডং। বান্দরবান শহর থেকে রুমা বাজার হয়ে বগালেকে এসে,এরপর বগালেক থেকে ট্রেকিং করে কেওক্রাডং এ যেতে হয়।
তাজিংডং (বিজয়)
তাজিংডং হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু স্থান বা পাহাড়।যা সমুদ্র পৃষ্ট হতে প্রায় তিন হাজার ৪০০ ফুট উচুঁ।রুমা থেকে তাজিংডং (বিজয়) এর দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার।পায়ে হেঁটে যেতে হয় এখানে।তবে শুষ্ক মৌসুমে জিপগাড়িতে করে তাজিংডং কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব।
বড়ইতলী:
বড়ইতলী ঝর্ণা কক্সবাজার বান্দরবান সীমান্তের নাইক্ষ্যাংছড়িতে। মেরিন ড্রাইভ রোড বা রামু দিয়ে এই ঝরনায় যাওয়া যায়।
জিংসিয়াম সাইতার :
জিংসিয়াম সাইতারে তিন ধাপ জুড়ে তিনটি ঝরনা রয়েছে।এটি রুমা থানার রুমানার পাড়ার পাশেই।
জাদিপাই ঝরনা :
বাংলাদেশের সব থেকে সুন্দর ঝরনার নামের তালিকায় সবার প্রথমে এটিই থাকবে। ঝরনাপ্রেমীদের প্রিয় একটি গন্তব্য হচ্ছে এই জাদিপাই ঝরনা। রুমা উপজেলার জাদিপাই পাড়ায় এই ঝরনাটি অবস্থিত।
তুইনুম ঝরনা :
তুইনুম অর্থ কালো পানি।এটি ম্রো ভাষার শব্দ।এটি আলিকদম উপজেলায় ম্রো সম্প্রদায় অধ্যুষিত ৪ নং কুরুকপাতা ইউনিয়নের তুইনুমে।
সোনাইছড়ি :
সোনাইছড়ি মূলত ট্রেকিং এরিয়া।গুহা, ঝরনা ও পাহাড় সব ধরনের অভিজ্ঞতা হবে। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে অটো বা সিএনজিতে করে ফকিরহাট রেললাইনে গিয়ে, সেখান থেকে ট্রেকিং শুরু করতে হয়।
মুনলাই পাড়া :
পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনধারা দেখার জন্য ট্র্যাভেলাররা যায়। মুনলাই পাড়াতে ৫৪টি আদিবাসী পরিবার বসবাস করে। রুমা বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে।
চিংড়ি ঝরনা :
বগালেক থেকে কেওক্রাডোং যাওয়ার পথেই চিংড়ি ঝরনা।
ফাইপি জলপ্রপাত :
বান্দরবানের থাইকাং পাড়ায় এই ফাইপি জলপ্রপাত অবস্থিত। থানচি বা রুমা দুদিক দিয়েই যাওয়া যায়।
বাকলাই ঝরনা :
বাকলাই গ্রাম থেকে ২ কিলোমিটার দূরের এই ঝর্ণা ৩৮০ ফুট উচু।এটি থানচি উপজেলার বাকলাই পাড়ায়,তাই একে বাকলাই ঝর্ণা বলে।
আন্ধারমানিক :
বান্দরবানের থানচি উপজেলার বড় মদক এলাকায় আন্ধারমানিকের অবস্থান। এর মূল আকর্ষন নারেসা ঝিরি।
এছাড়াও আরও ছোট ছোট স্পর্ট আছে যা যাওয়া আসার পথে পড়ে।যেমন- ডিমপাহাড়, পাতাং ঝিরি ঝরনা, রুপমুহুরী ঝরনা, বাদুরগুহা,আলীর সুরঙ্গ, লামোনই ঝরনা, তিন্দু, সাকাহাফং পর্বত,লিলুক ঝরনা, ন্যাচারাল পার্ক, রামজাদী মন্দির, রেমাক্রী বড়পাথর, দেবতা পাহাড়, ইত্যাদি।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে বান্দরবান যাওয়া যায়।আবার ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে বাস বা গাড়ীতে বান্দরবান যাওয়া যায়।এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ীত সরাসরি বান্দরবান যাওয়া যায়।
থাকবেন কোথায় ?
বান্দরবনে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউজ আছে।বান্দরবান শহরের সবচেয়ে কাছে হলো পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল মেঘলা।এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ছোট বড় হোটেল আছে যারা বাজেট ট্র্যাভেল করে তারা থাকার জন্য সুবিধা ও সাধ্যমত বেছে নিতে পারে।তবে লাক্সারি রিসোর্ট গুলোতে থাকতে হলে শহর থেকে দূরে যেতে হবে।
কীভাবে ঘুরবেন?
বান্দরবানের বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় বেড়ানোর বিভিন্ন ধরনের গাড়ি ব্যবহার করে টুরিস্টরা।কেউ রিসোর্টের গাড়ি ভাড়া নিয়ে বেড়ায়,কেউ ব্যক্তিগত গাড়ীতে বেড়ায়, কেউ স্থানীয় লোকাল যানবাহন ব্যবহার করে।তবে আমার কাছে বান্দরবানে বেড়ানো জন্য উত্তম মনে হয় চাঁদের গাড়ি।খোলা গাড়িতে চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাওয়া যায়।
টিপস
বান্দরবানের মশা খুব ভয়ংকর।তাই এন্টি বাগস্ ক্রীম নিতে ভুল করবেন না।
বান্দরবানে নেটওয়ার্ক থাকে না বেশি সময়,তাই যখন সংযোগ পাবেন আপনজনকে মেসেজ দিয়ে রাখবেন।
0 মন্তব্যসমূহ