up

#কুয়াকাটা ভ্রমণ


কুয়াকাটা নাম শুনলেই বাংলাদেশিদের চোখে ভেসে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর বেলাভূমি, দিগন্তজোড়া সুনীল আকাশ, নারিকেল বীথির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক মোহময় লীলাভূমি।যাকে আদর করে ডাকা হয়  “সাগর কন্যা।পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার লতাচাপলি ইউনিয়নের প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই দৃষ্টিনন্দন সমুদ্র সৈকত।খুব ভোরে লাল কমলা রঙের থালার মতো সূর্যটা সাগরে পানিতে রঙিন ছায়া ফেলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসা বা গোধূলি বেলায় আকাশ জুড়ে রঙিন শিল্পকলা সৃষ্টি করে আস্তে আস্তে সাগরের বুকে আস্ত সূর্যটার ডুব দেয়ার অভাবনীয় দৃশ্য অবলোকন করাতে টুরিস্টদের আকর্ষণীয় গন্তব্য কুয়াকাটা।কারন বাংলাদেশের একমাত্র এখন থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যায়।কুয়াকাটার এই বৈশিষ্টই অনন্য।সূর্যোদয় দেখার জন্য সবচেয়ে ভাল স্থান  সৈকতের পূর্ব প্রান্তের গঙ্গামতির বাঁক, আর সূর্যাস্ত দেখার  জন্য সৈকতের পশ্চিম প্রান্ত।এছাড়াও কুয়াকাটার আশেপাশের চরগুলোর প্রাকৃতিক ম্যানগ্রুভ বন কুয়াকাটাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।


গঙ্গামতির চর 
কুয়াকাটায় টুরিস্টদের মূল আকর্ষন হলো গঙ্গামতি চর। এই মায়াময় চর কুয়াকাটা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব দিকে।গঙ্গামতি চরের একতীর ক্রমশ ঢালু হয়ে সাগরের বুকে নেমে যাওয়া ভাঁজপড়া বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা হলো পৃথিবীর অন্যন্য সৌন্দর্যে অবগাহন করা।এখান থেকে সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় দুটোই অপূর্ব, তবে যেহেতু থাকার মতো স্থান নেই তাই সূর্যাস্তই দেখতেই আসে এখানে। গঙ্গামতিচরের পাশে গঙ্গামতি বা গজমতির জঙ্গল।এই প্রাকৃতিক বনে কেওড়া, গেওয়া, ছৈলা, খৈয়া সহ বিভিন্নরকমের গাছগাছালির ঘন সবুজে হারানোর মজাই আলাদা।বনের গাছগুলো কিন্তু নিঃসঙ্গ নয়,তাদের সঙ দিতে আছে বানর, বাদুড়, বন মোরগসহ নানা রকমের পাখি।তবে মনের আনন্দে বনের মাঝে ঘুরতে গিয়ে সাবধানতার কথা ভুলবেন না।কারন বুনোশুয়োর, অজগর সাপের মতো প্রাণীদেরও এখানে অবাধ বিচরণ।গঙ্গামতির আসল সৌন্দর্য কিন্তু বন বা সূর্যাস্ত না আমার মতে।আসল সৌন্দর্য হল লাল কাঁকড়ার দল। গঙ্গামতি চরের পূর্ব পাশে লাল কাঁকড়াদের নৃত্য লীলা দেখা যায়।তবে আসতে হবে  ভোরে।মানুষের চলাচল কম থাকে
তখন।তবে কারো করো মতে ১০/১১ বেটার সময় কাঁকড়া দেখার।সময় যাই কোন টুরিস্ট হিসেবে খেয়াল রাখবেন যেন তাদের জীবন বৈচিত্র্য নষ্ট না হয়। কুয়াকাটা থেকে এটাতে মোটরসাইকেল, ভ্যান এবং ট্রলারের করে যাওয়া যায় এই চরে।



লেবুর চর
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে গাছগাছালিকে ঘেরা এই প্রাকৃতিক বনের নাম লেবুর চর।কেউ কেউ একে মিনি সুন্দরবনও বলে।আগে এটি সুন্দরবনের সাথে সংযুক্ত ছিল,এখন বিছিন্ন।এর নামও কিছুটা আজব,পর্যটকরা লেবু বন বা বাগান মনে করে নাম শুনলে।বাস্তবে হলো লেম্বু ছিল রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি মেয়ে।তার বাড়ি ও বাগান এখানে ছিল।সমুদ্রে সে বাড়ি হারিয়ে গেছে।তার নামে এই জায়গার নাম লেম্বুর চর।১০০০ একর আয়তনের লেম্বুর চরে সুন্দরবনের মতো কেওড়া, গেওয়া, গোরান, কড়ই, গোলপাতাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আছে।এখানের মূল আকর্ষন হলো সূর্যাস্তের সৌন্দর্য।সূর্যাস্তের সময় বিস্তীর্ণ চরে আছড়ে পড়া সূর্যের সোনালি আভা চারপাশে এক মনোমুগ্ধকর অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণ করে।লেবুর চরের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে দিগন্ত রেখায় উঁকি দেয় সুন্দরবন।


সীমা বৌদ্ধ বিহার 
প্রাচীন কুয়ার কাছেই সীমা বৌদ্ধ বিহার।কাঠের অবকাঠামোর মন্দিরটি ভেঙে নতুন মন্দির হয়েছে।যাতে রয়েছে প্রায় সাঁইত্রিশ মন ওজনের অষ্ট ধাতুর তৈরি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি।


ফাতরার বন 
আন্ধারমানিক নদীর মোহনা পার হয়ে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষে এ গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ বনকে 'দ্বিতীয় সুন্দরবন'ও বলে স্থানীয়রা।কারণ এ বনের গাছগুলোর প্রজাতিগত ভাবে সুন্দরবনের সাদৃশ্য।বনের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটার একটা পথ আছে,যা সাগরের সাথে গিয়ে মিশে।চমৎকার অরণ্য ঘেরা পথটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনার সাথে দেখা হতে পারে হরিণ, বানর, শুকর, বন মোরগ, শিয়াল, বাঘডাস, মেছোবাঘ, ভোদর, খরগোশ, অজগর সহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর।তবে দূর থেকে দেখাই উত্তম😂।বর্তমানে পরিবেশ রক্ষায় সরকারি ভাবে পরিকল্পিত বনায়ন করা হচ্ছে।


কুয়াকাটার 'কুয়া' 
কুয়াকাটা নামটির উৎপত্তি  কুয়া থেকে।ধারণা করা হয় ১৮ শতকে মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে আরকানরা এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে।তখন এখানে পানীয় জলের সংকটের সমাধান করতে এই কুয়া খনন করা হয়।তখন মিষ্টি পানির একমাত্র আধার ছিল এই কুয়া। ভূগর্ভস্থ পানি বা বর্ষার পানি সংরক্ষণ করা হতো এই কুয়ায়।কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের কাছে রাখাইন পল্লী কেরানীপাড়ার বৌদ্ধ বিহারের সামনে এই ২০০ বছরের পুরানো কূপটি।যা এখন সরকারের আর্থিক সহায়তায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে।এক সময়ের মিষ্টি পানির একমাত্র উৎস, এখন ঐতিহ্যের অংশ।


মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ বিহার 
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্বে রাখাইন আদিবাসীদের আবাসস্থল মিশ্রিপাড়ায় একটি বৌদ্ধ বিহার আছে।এখানে প্রায় দুশো বছরের পুরাতন বৌদ্ধমূর্তি আছে।কারো কারো মতে এটি ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ মূর্তি।


সোনারচর
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে সোনার চর।প্রায় ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সমুদ্র সৈকত থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায়। দিগন্ত বিস্তৃত সাগরের নীল জলরাশি ঘেরা সোনারচরে বালিতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে যেন সোনার মতই মনে হয় বলে নামকরণ সার্থক।এমন দৃষ্টিনন্দন ও নয়ানাভিরাম সমুদ্র সৈকত দেখতে হলে বিপদসঙ্কুল দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে।অনিরাপদ যোগাযোগ
ব্যবস্থা উপেক্ষা করার সাহস থাকলেই কেবল প্রকৃতির এমন অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করা যাবে।এখানে সমুদ্র সৈকত জুড়ে কোটি কোটি লাল কাঁকড়ার বিচরণ দেখে মনে হবে যেন লাল কাঁকড়ার ভিন্ন এক জগত।মনে হবে গোটা সৈকত লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছে কেউ।এছাড়াও জীববৈচিত্রপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের অন্যান্য সৌন্দর্য তো আছেই।তবে কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা বেশির ভাগ মানুষ সোনার চরে যায় না।


শুঁটকিপল্লি 
কুয়াকাটার আরেক আকর্ষণ শুঁটকিপল্লি।কুয়াকাটায় গিয়ে প্রায় সবাই শুঁটকি পল্লীতে যায়।কেউ কিনতে যায়, কেউ যায় দেখতে।স্থানীয় ভাবে শুঁটকির খুব একটা চাহিদা না থাকলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে শুটকির চাহিদা থাকায় কুয়াকাটায় শুটকি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়।সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম পাশে অস্থায়ীভাবে বাঁশ দিয়ে শুটকির মাচা তৈরি করে মাছ শুকনো হয়। বিশাল এলাকা জুড়ে মাচা বানিয়ে শুঁটকি তৈরির ওপেন কারখানা দেখে টুরিস্টদের মজার অভিজ্ঞতা হয়। এখানে অনেক কম দামে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের শুটকি পাওয়া যায়।বিশেষ করে ইলিশ, রূপচাঁদা, হাঙর, লইট্যা, শাপলাপাতাসহ অসংখ্য প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি বানিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়।


কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান বা ইকোপার্ক
কুয়াকাটা জিরোপার্ক থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্ব দিকে সাগরের গা ঘেঁষে প্রায় ৭০০ একর জায়গা জুড়ে কুয়াকাটা ইকোপার্ক অবস্থিত।এখানে পরিকল্পিত ভাবে নারিকেল কুঞ্জ, ঝাউবন সহ বিভিন্ন গাছগাছালি লাগিয়ে বনায়ন করা হয়।সমুদ্রের ভাঙ্গন ঠেকানো ও পরিবেশ উন্নয়ন হলো এই বনায়নের প্রধান উদ্দেশ্য।তবে বর্তমানে সাগরের অব্যাহত  ভাঙ্গনে নারিকেল কুঞ্জের অনেকটুকু অংশ সাগরে হারিয়ে গেছে।মানব সৃষ্ট হলেও গোধূলী বেলায় সমুদ্র সৈকত থেকে নারিকেলের গাছ ও ঝাউবাগানের পরিবেশকে এমন স্বর্গীয় মনে হয় যে সময়ের কাটাকে যে কারো থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।সমুদ্রের নির্মল লোনা বাতাস আর ঝাউবনে বহমান  বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ এক নিরবিচ্ছিন্ন ঐক্যতান সৃষ্টি করে, শ্রোতার কানে আনে অনির্বাচনী মাদকতা। 


নৌকা জাদুঘর
শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার ও রাখাইন মার্কেটের সংলগ্ন ভেড়িবাধের ঢালে একটা ব্যতিক্রমী জাদুঘর আছে।দেশের একমাত্র নৌকা জাদুঘর এটি। এখানে একটি পাল তোলা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। নৌকাটি ৭২ ফুট দৈর্ঘ্য, ২২ ফুট প্রস্থ, ১১ ফুট উচ্চতা এবং ৯০ টন ওজনের। প্রাচীনকালে সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসা করার জন্য এমন পাল তোলা জাহাজ সেসময় ব্যবহার করা হতো।


দেড়শ বছরের পুরোনো এ জনপদে আরও অনেক কিছু দেখার আছে।যেমন-একমাত্র পানি জাদুঘর, কানাই বলাই দিঘী, কাজলারচর, পায়রা বন্দর ,ঝাউতলা, চর বিজয়, শ্রীরামপুর জমিদার বাড়ি, মিঠাপুকুর রিভারভিউ পার্ক, শেখ রাসেল শিশু পার্ক, সৎসঙ্গের শ্রী শ্রী অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম,ইয়ারউদ্দিন খলিফার মাজারসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান।


এককথায় বলতে গেলে কুয়াকাটা হলো তেমনই একটা গন্তব্য যেখানে সাগরের গর্জনসহ বিশাল আকৃতির ঢেউয়ের জলরাশি একের পর এক সৈকতে আছড়ে পড়ার মতো, প্রকৃতি প্রেমীদের সকল ক্লান্তি ধুঁয়ে মুছে যায়।


কিভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দূরের কুয়াকাটায় বিভিন্ন ভাবে যাওয়া যায়।ঢাকা থেকে বিভিন্ন সংস্থার বাসে কুয়াকাটায় যাওয়া যায়।আবার লঞ্চ পটুয়াখালী পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে সড়ক পথে কুয়াকাটা যাওয়া যায়।এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ীতেও যাওয়া যায়।তবে লঞ্চ বা ব্যক্তিগত গাড়ী যে কোন একটা বেচে নেয়া আনন্দদায়ক।

কোথায় থাকবেন:
আগে কুয়াকাটায় থাকার মতো ভালো মানের হোটেলের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকটি ছিল, কিন্তু এখন প্রায় শতাধিক হোটেল আছে ব্যক্তিগত ও সরকারিসহ।তাই টুরিস্টরা বাজেট ও পছন্দ মতো হোটেল বেছে নিতে পারেন।কয়েকটি হোটেলের নাম হলো-হোটেল নীলঞ্জনা, হোটেল বি-ভিউ, হোটেল গোল্ডেন প্যারেজ, হোটেল বীচ-ভেলী, হোটেল ফ্যামিলী হোমস, হোটেল সাগর কন্যা, হোটেল সি-গার্ডেন ইত্যাদি।

টিপস 
১.বিনা ঝামেলায় বেড়াতে চাইলে ভালো হয় কুয়াকাটা সি-বিচ থেকে একটা ট্রলার সারাদিনের জন্য ১০০০-১২০০ টাকা দিয়ে ভাড়া নিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো ঘুরতে পারেন।তাহলে তারাই সব যায়গা দেখিয়ে নিয়ে আসবে।তবে অবশ্যই গঙ্গামতির চর থেকে সূর্যাস্ত দেখা উত্তম।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post