আমি রোজ সকালে যে কাল্পনিক ওয়াক ওয়েতে দৌঁড়াতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা লাগতে গেলে বাস্তবতায় ফিরে দেখি আমি রমনাপার্কই আছি😊।নিউক্যাসলের এক সকালে একপাশে সংরক্ষিত বন অন্য পাশে নদী মাঝে প্রসস্থ ওয়াকওয়েতে হাঁটতে গিয়ে আমার মনে হলো আমার কাল্পনার সীমা যেখানে শেষ এর সৌন্দর্য সেখান থেকে শুরু।আসলে আমরা যারা ঢাকার মতো শহরে বসবাস করি তাদের কাল্পনিক সৌন্দর্যের জগতের পরিধিও ছোট হয়ে গেছে।
নিউক্যাসল উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের টাইন অ্যান্ড উইয়ার কাউন্টিতে অবস্থিত একটি শহর।অতীতে এই শহর রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত পন্স অ্যালিয়াস নামে ছিল।প্রথম উইলিয়ামের জ্যেষ্ঠ্য পুত্র দ্বিতীয় ডিউক ১০৮০ সালে যখন নিউক্যাসল তৈরি করে তখন থেকে এই শহরের নতুন নাম হয় নিউক্যাসল। পাহাড়ি উঁচুনিচু টিলা, ছিমছাম গোছানো, সুদৃশ্য আর পরিচ্ছন্ন শহর এই নিউক্যাসল। টাইন নদী শহরটিকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। টাইন নদীর উপরে সুদৃশ্য বেশ কিছু ব্রিজ আছে।যা শহরকে দিয়েছে অন্যন্য স্বকীয়তা।
আমি ব্রেকফাস্ট সেরে আমি রিসিপশন ডেক্সের ফেন্ডলী এক মেয়ের কাছে জানতে চাইলাম কি কি দেখার আছে এই শহরে। সে আমাকে দু'মিনিট অপেক্ষা করতে বলে একটা ম্যাপ প্রিন্ট করে,তাতে দর্শনীয় জায়গা গুলো মার্ক করে দিলো ক্রমানুসারে।সাথে বলে দিলো এই জায়গা গুলো তুমি হেঁটে যেতে পারবে, যদি হাঁটার অভ্যাস থাকে।
প্রথমেই গেলাম বিখ্যাত নিউক্যাসল ক্যাসলে।কাসলটি পাহাড়ের উপর তৈরি।যেখান থেকে শহরের অধিকাংশ এলাকা দেখা যায়।এটি নিউক্যাসল আপন টাইন শহরের সবচেয়ে প্রাচীন কাঠামো।আনুমানিক ১২০০শতকে নির্মিত হয়েছিল ক্যাসলটি।এই রাজকীয় দুর্গ, এক সময় কারাগার হিসাবে ব্যবহার হয়েছিল,এখন একটি যাদুঘর।ক্যাসেলর উপর থেকে শহর দেখলে মনে হবে যেন ক্যাসেলটি পাহাড়ের উপর বসে পুরো শহরকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।রাজবাড়ী বলে কথা,নগরকর্তা যদি পুরো শহর না দেখে তাহলে কি চলে😊! তবে দুঃখের বিষয় আমি ক্যাসেলটি ঘুরে দেখতে পারি নাই,কারণ সেদিন ছিল রানির অন্ত্যষ্টিক্রিয়া।তাই জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ থাকায় আমি বাহিরের খোলা অংশ দেখে ফিরে আসতে হয়েছে।
ক্যাসেল থেকে বের হয়ে হেঁটে গেলাম নিউক্যাসেল সেন্টাল গির্জায়।সেখানেও নোটিশ ঝুলছে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ।শুধু মাত্র যারা প্রার্থনায় যারা অংশ নিবে তারা প্রবেশ করতে পারবে।আমি চিন্তা করলাম আমার তো প্রার্থনায় অংশ নিতে সমস্যা নেই।ভিতরে প্রবেশ করা কিছু সময় প্রার্থনায় অংশ নিলাম,তারপর অন্য মতো আমিও গীর্জার পুরো অংশ ঘুরলাম।এখানেও চলছে রানীর অন্ত্যষ্টিক্রিয়া উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন।বেজে চলছে গীর্জার ঘণ্টা একটানা,চলবে অন্ত্যষ্টিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত।তাদের রানীর প্রতি এই সম্মানবোধ দেখে ভালো লাগলো আমার।
গীর্জা থেকে বের হয়ে খাবারের জন্য রেস্তোরাঁ খুঁজতে গিয়ে জানলাম আজ সব বন্ধ, অন্ত্যষ্টিক্রিয়া জন্য।অগত্যা হোটেলে ফিরে গেলাম।
বিকেলে বের হয়ে টাইন নদীর উপর তৈরি সুদৃশ্য 'মিলেনিয়াম ব্রিজ' দেখতে গেলাম।ব্রিজগুলো সব কাছাকাছি দূরত্বে এবং আমার হোটেল থেকে হাঁটা দূরত্বে।ব্রিজগুলো মধ্যে মিলেনিয়াম ব্রিজটা বেশি সুন্দর।এটি জাহাজ চলাচলের জন্য মাঝখানে উম্মুক্ত হয়ে যায়। জাহাজ চলে গেলে আবার ব্রিজটা দুই দিকে থেকে এক হয়ে যায়। অনেকটা লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজের মতো।যদিও আমাদের সেই সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয় নাই।বিকালটা আমার কেটে গেছে ব্রিজ গুলো দেখে আর ব্রিজ এলাকার ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটের হরেকরকমের জিনিস দেখে।
পরেব দিন ব্রেকফাস্ট সেরে গেলাম গ্রে-এর স্মৃতিস্তম্ভ বা গ্রে'স মনুমেন্ট। গ্রে'-এর স্মৃতিস্তম্ভটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চার্লস গ্রে-এর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নির্মিত হয়েছিল।গ্রে ২২ বছর বয়স থেকে সংসদে নর্থম্বারল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করেছিল।তাকে ১৮০৬ সালে 'ফার্স্ট লর্ড অব দ্য এডমিরালটি' এবং পরে 'হাউস অব কমন্সের' নেতা করা হয়। তিনি ১৮৩০ সালে এ প্রধানমন্ত্রী হয়ে গ্রেট রিফর্ম অ্যাক্ট পাশ করেন।তিনি তখন অনেক সংস্কারমূলক কাজ করেছিলেন।
স্মৃতিস্তম্ভটি প্রায় ১৩৩ ফুট (৪১ মিটার)উচ্চতার।এটি গ্রে, গ্রেঞ্জার ও ব্ল্যাকেট রাস্তার মোডের উপর।স্মৃতিস্তম্ভটি স্থানীয় স্থপতি বেঞ্জামিন গ্রিন দ্বারা নকশা করা হয়েছিল, এবং ভাস্কর্য শিল্পী এডওয়ার্ড হজেস বেইলি তৈরি করেন।স্মৃতিস্তম্ভের চারপাশ বেশ সুন্দর করে গোছানো,বসার জন্য বেঞ্চপাতা আছে।আশেপাশে শপিং করার মতো শপ থাকায় এবং নামীদামী রেস্তোরাঁ থাকায় এলাকাটি বেশ জমজমাট।
হোটেলে না ফিরে এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম একজন স্টীট পারফরমারের গিটার শুনতে শুনতে।ইউরোপ এসে এই বিষয় আমি খুব উপভোগ করছি।এখানের মানুষের হ্যাপি চেহারা আর স্টীট পারফরম্যান্স।যতটুকু সম্ভব হয়েছে ততটুকু দিয়েছি প্রতিটি পারফরমারের ক্যাপে।বিনামূল্যে কোন সেবা নেয়াটা কেমন যেন লাগে আমার।
এরপর আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম আমার পরবর্তী গন্তব্য Laing আর্ট গ্যালারিতে।ভবনটিকে বাহির থেকে দেখলেই অনুমান করা যায়,ভিতরে কোন শিল্পকর্মই অপেক্ষা করছে।বাহিরের খোলামেলা চত্বর পেরিয়ে ভিতরে গিয়ে চোখ বিস্ময়ে বড়ো হয়ে গেলো পেইন্টিং, ভাস্কর্য, এবং আলংকারিক শিল্পের একটি চিত্তাকর্ষক সংগ্রহ দেখে।আমি প্রতিটি তলার প্রদর্শনী ঘুরে দেখলাম প্রচণ্ড রকমের আগ্রহ নিয়ে।যদিও আমি শিল্পবোদ্ধা নই,তবে শিল্প প্রেমী।তাই নতুন দেশের শিল্পীদের কাজ দেখতে চমৎকার লাগছিল।চতুর্থ তলায় সমসাময়িক শিল্পীদের একটা প্রদর্শনী চলছিল সেখানে বেশ মানুষ জন ছিল।একটা ফ্লোরে ছিলো নারী মানবাধিকার কর্মীদের নিয়ে প্রদর্শনী ছিলো।সেখানে আমি বাংলাদেশের কাউকে পাই কি না অনেকক্ষণ খুঁজলাম।একজনকে শাড়ী পরা দেখে তাঁর নাম shehla masood দেখে বাংলাদেশের কেউ ভেবে খুব খুশী হয়েছিলাম।পরে অবশ্য গুগল করে দেখলাম উনি ভারতীয়।আরো কয়েকজন ভারতীয় নারীর নাম দেখেছিলাম অবশ্য।এই সেন্টারটিতে কোন টিকেট ছাড়া প্রবেশ করা যায় এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পীদের কাজ উপভোগ করা যায়।
বের হওয়ার পথে একটা বুক শপ ছিলো হেঁটে হেঁটে বই দেখলাম,যদিও কিনি নাই।কেননা আমি বাংলা বই পড়ি,যা এখানে নেই।তবে দেখতে আমার ভালো লাগে।সবশেষে একটা কফি শপে বসলাম কফি খেতে।অর্ডার দিতে গিয়ে জানলাম ফ্রী কফি, চা প্রোভাইট করা হচ্ছে।একজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম এখানে বলে শিল্পবোদ্ধারা শিল্প নিয়ে আলোচনা করবে, নতুন নতুন শিল্পের জন্ম হবে।আর তাদের আড্ডা জমানোর জন্য এই ফ্রী কফি, চা।আমি তো অবাক,আমাদের দেশে কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে অপচয় হয়, কিন্তু কোন কর্তাব্যক্তিরা কখনো এমন উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবতেও পারবে না।
নিউক্যাসলে মাত্র তিন রাত, চার দিন কাটালেও ছিমছাম সুন্দর গোছানো শহরটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।এখানকার মানুষজনের উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং সহযোগিতা আমি উপভোগ করেছি।সকালবেলার টিপটিপ বৃষ্টির ভিতর দিয়ে আমাদের ট্রেন ছুটেছে এডিনবার্গের দিকে।আর আর ট্রেনের ঝাপসা কাঁচের বাহিরে দেখার চেষ্টা করছিলাম শেষবারের মতো ক্ষণিকের অতিথিকে আপন করে নেয়া শহরটাকে।
#কোথায় থাকবেন:
নিউক্যাসেলে সব ধরনের থাকার ব্যবস্থা আছে। বলতে বলা যায় লন্ডন থেকে অনেক কমে হোটেল মিলে।এখানে যাওয়া আগেই নিজের বাজেট ও পছন্দ মতো হোটেল বুকিং দেয়ার জন্য বুকিং ডটকম, ট্রিপ এডভাইজার ব্যবহার করতে পারেন।তবে হোটেল, সার্ভিসড অ্যাপার্টমেন্ট বা হলিডে লেট খুঁজে পাওয়ার সবচেয়ে ভালো জায়গা হল বুক ডাইরেক্ট এবং সেভের মাধ্যমে।এছাড়া Airbnb তেও ভাড়া কম পড়ে।
0 মন্তব্যসমূহ